কিশোর-কিশোরী ক্লাব

শিক্ষক না এলে ক্লাস-নাশতা দুটোই থাকে বন্ধ

শামীম সরকার শাহীন
শামীম সরকার শাহীন শামীম সরকার শাহীন গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ১৬ আগস্ট ২০২৩

ক্লাস হয় না নিয়মিত। কোথাও হলেও নেই নির্ধারিত সংখ্যক শিক্ষার্থী। যে কয়জন আছে তাদের আবার নেই পোশাক। না আছে ডায়েরি ও আইডি কার্ডসহ শিক্ষা উপকরণ। প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চলছে কোথাও কোথাও। তবলচি নেই কোনো ক্লাবে। আবার কোথাও কোথাও নষ্ট হয়ে পরে আছে হারমোনিয়াম আর তবলা। পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক না এলে ক্লাস-নাশতা দুটোই বন্ধ থাকে।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৬ কিশোর-কিশোরী ক্লাবে এমন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের নজরদারি না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ক্লাবগুলোতে ক্লাস নেওয়ার নিয়ম। ক্লাবপ্রতি ৩০ জন করে সদস্য বা শিক্ষার্থী থাকবে। এরমধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ২০ কিশোরী ও ১০ কিশোর। সংগীত, আবৃত্তি, কারাতের মতো সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও মাদক প্রতিরোধ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করাই এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ১৬ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে। নিয়মে বলা আছে, শুক্রবার সংগীত ও শনিবার আবৃত্তি শেখানো হবে। সংগীত ও আবৃত্তির দুইজন শিক্ষকও আছেন। ৩০ টাকা মূল্যে ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ প্যাকেট পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের নিয়মও আছে। থাকতে হবে হারমোনিয়াম, তবলা, লুডু, দাবা ও ক্যারাম। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পোশাক, আইডি কার্ড ও ডায়েরিসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ থাকার কথা ছিল।

গত একমাসে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলার বামনডাঙ্গা, বেলকা, দহবন্দ, সর্বানন্দ, রামজীবন, ধোপাডাঙ্গা ও কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নে স্থাপিত কিশোরী-কিশোরী ক্লাবগুলো ঘুরে নানা অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়।

উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের জামাল হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রেণিকক্ষ খোলা থাকলেও নেই কোনো শিক্ষার্থী। টেবিলের ওপরে পড়ে আছে রুমের তালা আর বেত। অপেক্ষার পর ৫টা ১০ মিনিটের দিকে ফোন দেওয়া হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মাহাবুর রহমানকে। জানান তিনি বাইরে আছেন। কিশোর-কিশোরী ক্লাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তার পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। সেক্ষেত্রে তাকে আগে খোঁজ নিতে হবে।

ফোন কেটে দিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় ক্লাবের তিন শিক্ষার্থীকে ডেকে নেন প্রতিবেদক। কথা হলে তাদের একজন বললো, ‘আজ এবং গতকাল স্যার আসেননি। আমরা কয়েকজন করে এসেছিলাম।’ স্যার না আসলে নাশতা দেওয়া হয় না বলেও জানায় শিক্ষার্থীরা। এছাড়া নানা অনিয়মের কথা উঠে আসে ওই তিনজনের বক্তব্যে। আর এ চিত্র কেবল এ ক্লাবেই নয়।

বেলকা ইউনিয়নের চৌমুহনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবে গিয়ে সংগীত শিক্ষক বিপ্লবী সরকারের দেখা মিললেও নানা অনিয়মের কথা উঠে আসে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে। হারমোনিয়াম ও তবলা নষ্ট। রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা ১৬ শিক্ষার্থীর। বন্ধ ছিল ওয়াশরুমও। নেই শিক্ষার্থীদের পোশাক, আইডি কার্ড ও ডায়েরিসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী। আবৃত্তির শিক্ষক না থাকায় জেন্ডার প্রমোটর দিয়ে চলে আবৃত্তি ক্লাস। ৩০ টাকা মূল্যের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের কথা থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে ২০ টাকা মূল্যের কেক ও বিস্কুট। এর আগের শনিবার ক্লাস হয়নি বলেও জানায় শিক্ষার্থীরা।

দহবন্দ ইউনিয়নের হুড়াভায়া খাঁ এ মান্নান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, ১৩ শিক্ষার্থী ক্লাসে। আবৃত্তির শিক্ষক না থাকায় ক্লাস নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জেন্ডার প্রমোটর খোকন কুমার সরকার।

রামজীবন ইউনিয়নের বাজারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবে দেখা যায়, তিন/চারজন শিক্ষার্থীকে কাছে নিয়ে আবৃত্তির পরিবর্তে গান শেখাচ্ছেন সংগীত শিক্ষক বাবু রাম মহন্ত। বাকি শিক্ষার্থীরা যে যার মতো করে বসে গল্প করছে। কেউ আবার রুমের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শেষমেশ বিকেল ৫টা ১০ মিনিটের দিকে আসেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জেন্ডার প্রমোটর ফিরোজা আক্তার। তিনি বলেন, এখানকার আবৃত্তি শিক্ষক না থাকায় গত জানুয়ারি থেকে আমি ক্লাস নিচ্ছি। দেরিতে আসার কারণ জানতে চাইলে বলেন, রামজীবন, ধোপাডাঙ্গা ও তারাপুর ইউনিয়নসহ পৌরসভা দেখতে হয় আমাকে। সে কারণে টাইমিংয়ে সমস্যা হয়।

ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবের সংগীত শিক্ষক রীনা রহমান বলেন, ‘হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় থানা ফার্স্ট হয়েছিল আমার মেয়ে। আজকে জেলায় অনুষ্ঠান। সেখানে তাকে নিয়ে এসেছি। সে কারণে ক্লাসে যেতে পারিনি। তবে বিষয়টি জানাতে জেন্ডার প্রমোটরকে একাধিকবার ফোন দিয়েছি। তিনি ফোন ধরেননি।’

অনুপস্থিত থাকার কারণ জানতে চাইলে আবৃত্তি শিক্ষক আরমান বলেন, আমি জেন্ডার প্রমোটরকে বিষয়টি জানিয়েছি।

তবে জেন্ডার প্রমোটর খোকন কুমার সরকার ফোন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ঢাকায় ছিলাম সে কারণে আসতে পারিনি।

এ বিষয়ে তদারকির দায়িত্বে থাকা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতা সুমী কায়সার বলেন, আবৃত্তির শিক্ষক সংকট ছিল ও তবলচি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি আবৃত্তি শিক্ষা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাদ্য না দেওয়ার বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, আপনি যেসব ক্লাবে এ ধরনের তথা পেয়েছেন, আমাকে বলেন আমি সেগুলোতে অভিভাবক সমাবেশ করবো। পোশাক, আইডি কার্ড ও ডায়েরি নেই এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, বরাদ্দ যা পেয়েছি সেগুলো দিয়েছি।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মো. আবুল ফাত্তাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেক ও বিস্কুট পুষ্টিকর খাদ্য নয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডিম, দুধ ও ফল থাকতে হবে।’

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নূর-এ- আলম বলেন, শিক্ষক সংকট ছিল। সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা রাখি, এখন শিক্ষার্থী বাড়বে। কেন শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া হচ্ছে না সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।