চায়না দোয়ারা গিলছে মৎস্য বিভাগের পোনা

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা
প্রকাশিত: ০৮:০৬ এএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বর্ষা মৌসুমে পৌনে দুই লাখ পোনা ছাড়ার পরও মাছশূন্য পাবনার ২১২টি বিল ও ১০৬ খাল। সর্বগ্রাসী চায়না দোয়ারা জাল দিয়ে পোনাসহ সব দেশি মাছ উজাড় করেছে একশ্রেণির জেলে। এতে মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে বিলে ছাড়া পৌনে দুই লাখ পোনা কার্যত ‘জলে গেছে’।

মৎস্য বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত র‌্যালি, সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ সবই ভেস্তে যেতে বসেছে। এতে মুক্ত জলাশয়ে টেকসই মৎস্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। যদিও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা দেশি মাছ সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, বর্ষার শুরু থেকেই বেড়জাল ও কারেন্টজাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ। অতিলোভী কিছু মানুষ মাছের ডিম ও পোনা ধরে দেশি মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। দেশি প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছ এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, রিটা, তারাবাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০ জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

পাবনার বিখ্যাত চলনবিল, গাজানা বিল, বিল গ্যারকাসহ সব বিল মাছশূন্য হতে চলছে। হাতেগোনা কয়েকজন লোভী জেলের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে বিলের বাহারি জাতের মাছ উজাড় করছেন।

জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, পাবনায় মোট ২১২টি বিল, ১০৬টি খাল ও ১১টি নদী রয়েছে। এছাড়া ২৩৩টি প্লাবনভূমি ও ৬৩৫টি বড়পিটে এবং ৬৯৬ হেক্টর জমির ধানক্ষেতে মাছচাষ করা হয়। তৃণমূল পর্যায়ে আমিষের জোগান বাড়ানোর লক্ষ্যে এবারও পাবনার বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা মাছ অবমুক্ত করা হয়। খাস, সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক জলাশয় ও বর্ষাপ্লাবিত ধানক্ষেতে জেলা মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে এক লাখ ৭৪ হাজার (৩.৭৬ মেট্রিক টন) পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন বিলে পোনা নার্সারি স্থাপন করা হয়। অবমুক্ত করা পোনা মাছের প্রজাতির মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছ রয়েছে।

মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান শর্তই হচ্ছে গুণগত মানসম্মত পোনার সহজলভ্যতা। পরিবেশ ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাকৃতিক উৎসে রেণুসহ পোনা উৎপাদন ও আহরণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারিভাবে বিল নার্সারি স্থাপন করে পোনা উৎপাদন ও অবমুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে বিলপাড়ের বাসিন্দারা জানান, বিভিন্ন জলাশয়ে পোনা মাছ অবমুক্ত করা হলেও চায়না দোয়ারার দাপটে সেগুলো টিকতে পারছে না। পোনাগুলো বলতে গেলে ছেঁকে ছেঁকে ধরা হচ্ছে। তাই সরকারিভাবে পোনা উৎপাদন ও মাছের বংশ বৃদ্ধির উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।

তারা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের পাশাপাশি মৎস্য বিভাগের ছাড়া পোনা মাছে বিল পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সর্বগ্রাসী চায়না দোয়ারা জালে পোনাসহ সব মাছ উজাড় হওয়ার পথে।

তারা জানিয়েছেন, বিল নার্সারি কার্যক্রম গ্রহণ, মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ, মৎস্য অভয়াশ্রম সৃষ্টিসহ যাই করা হোক সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মৎস্য অফিস থেকে নিতে হবে। শুধু হিসাবের খাতায় সংখ্যা যোগ করলে হবে না। মাছের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে সেটাও দেখতে হবে।

বিল গ্যারকা পাড়ের বাসিন্দা সাগর হোসেন ও জসীম উদ্দিন জানান, গ্যারকা বিলে প্রতিদিন কয়েকশো চায়না দোয়ারা জাল পাতা থাকে। এখানে আজ পর্যন্ত কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। পার্শ্ববর্তী বিলে তারা দেখেছেন অভিযানের সংবাদ ফাঁস হয়ে যায়। এতে অসাধু জেলেরা অভিযানের দিন তাদের জাল ডুবিয়ে রাখেন। এজন্য একেক বিলে অন্তত ৪-৫ বার অভিযান চালানো দরকার। না হলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশি মাছ বলে আর কিছু থাকবে না।

তারা জানান, বিলের মাছ যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে সভা-সমাবেশ বা র‌্যালি কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এজন্য বিলে গোপনে অভিযান চালানোর কোনো বিকল্প নেই।

সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে দেশি মাছ কিনতে আসা প্রবীণ ব্যক্তি মোকাদ্দেছ মোল্লা (৭০) জানান, বাজারে তিনি মাছ কিনতে এসেছেন। কিন্তু তার পছন্দের মাছই বাজারে পাননি।

তিনি জানান, বাজারে আগের মতো দেশি জাতের মাছ নেই। বিলে পানি নেই, তাই মাছ কম। আর যে মাছ আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। একেবারে ছোট ছোট মাছ ধরছে জেলেরা। এখন পোনাসহ মা মাছ ধরছে তারা। কিন্তু ২-১ মাস পরেতো বিলে মাছই পাওয়া যাবে না।

বাজারে মাছ কিনতে এসে একইরকম কথা বললেন স্কুলশিক্ষক কৃষ্ণলাল কর্মকার। তিনি জানান, এখন বিলের মাছ খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারা জালের মতো সুক্ষ জাল দিয়ে মেরে নির্বংশ করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, এখনই বিল এলাকায় এবং বিলের পাশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালানো দরকার। অনেক বাড়িতে চায়না দোয়ারা জাল রয়েছে। সেগুলো জব্দ করে ধ্বংস করা হোক। আর দোষীদের জেল-জরিমানা করলে তাদের রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে পাবনার কৃষিবিদ জাফর সাদেক বলেন, মুক্ত জলাশয়ের মাছ অধিক নিরাপদ, সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন। তাই এ মাছের চাহিদাও বেশি। কিন্তু জোগান কম। চায়না দোয়ারা জালের আগ্রাসনে বিলের পানিতে পোনাই যদি টেকানো না যায় তাহলে মুক্ত জলাশয়ে টেকসই মৎস্য উৎপাদন কীভাবে সম্ভব হবে? চায়না দোয়ারা জাল ধ্বংস করতে বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বিলে একাধিক অভিযান চালানো দরকার।

পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে মুক্ত জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ। কিছু অসাধু ব্যক্তি এখন চায়না দোয়ারা জাল ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধে এবার অভিযান জোরদার করা হবে।

এফএ/এএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।