সন্তানকে দত্তক দিয়ে হাসপাতালের বিল পরিশোধ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাজীপুর
প্রকাশিত: ০৭:০৮ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০২৩

সিজারিয়ান অপারেশনের পর বিল পরিশোধ করতে না পেরে নবজাতককে দত্তক দিয়ে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেছে অসহায় এক পরিবার। সন্তান ফিরে পাওয়ার আশায় এলাকার সমাজপতিদের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোনো ফল মেলেনি অসহায় এ মায়ের। সন্তানহারা মায়ের কান্নায় যেন মন গলছে না কারোরই।

শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে গাজীপুরের শ্রীপুরের ফরিদপুর গ্রামে কথা হয় নবজাতকের মা শিরিন আক্তারের সঙ্গে। শিরিন আক্তারের (২০) বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মনিকুরা গ্রামে। তিনি মা-বাবার সঙ্গে শ্রীপুরের ফরিদপুর গ্রামে ভাড়া থাকেন। তার আবু জাহিদ নামে দেড় বছর বয়সী আরও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।

শিরিনের পরিবার জানায়, শিরিন আক্তারের স্বামী আরিফুল ইসলাম বিভিন্ন পরিবহনে সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করেন। তিনি মাদকাসক্ত। বিভিন্ন সময় তাকে মাদক ছাড়তে অনুরোধ করার পরও তিনি মাদক না ছাড়ায় ৪-৫ মাস আগে তার সঙ্গে পরিবারের দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তার।

গত ১৬ অক্টোবর সন্তানসম্ভবা শিরিন আক্তারকে নিয়ে ময়মনসিংহের চরপাড়া এলাকার স্বাধীন নার্সিং হোমে ভর্তি করান বাবা সিরাজুল ইসলাম। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন শিরিন আক্তার।

শিরিন আক্তারের বাবা সিরাজুল ইসলাম স’মিলের (কাঠ চিরাই কল) মিস্ত্রি। বাড়তি আয় করতে মাঝে মধ্যে অটোরিকশাও চালান।

তিনি বলেন, স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়ে আমাদের কাছে থাকে। সন্তানসম্ভাবা মেয়েকে নিয়ে মাথায় বাড়তি চাপ ছিল। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশী শামসুন্নাহার নামের এক নারীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। ওই নারী আমার মেয়ের সিজারিয়ান অপারেশন করতে ১৩ হাজার টাকায় ময়মনসিংহের স্বাধীন নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করেন। গত ১৬ অক্টোবর চুক্তি অনুযায়ী টাকা জোগাড় করে স্বাধীন নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে শিরিনকে সিজারিয়ান অপারেশন করানো হয় এবং একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।

তিনি বলেন, ১৯ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার দিন আমাদের জানানো হয়, হাসপাতালের বিল ২৪ হাজার ৫০০ টাকা হয়েছে। তাদের এমন কথায় আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। তারা আমাকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে। তবে ওই সময় আমার কাছে শুধু ১৩ হাজার টাকা ছিল।

এক পর্যায়ে শামসুন্নাহার নবজাতককে দত্তক দেওয়ার পরামর্শ দেন। ওই নারী বলেন, সন্তান দত্তক দিলে হাসপাতালে বিল পরিশোধ করে নগদ কিছু টাকাও দেওয়া হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি করা অতিরিক্ত টাকা দিতেই নবজাতককে শামসুন্নাহার ও আল-আমিনের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আমার মেয়ে সন্তানের জন্য শুধুই কেঁদে চলেছে। আমরা সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে গেলে তারা এখন ৭০ হাজার টাকা দাবি করছেন। বলছেন এ টাকা না দিলে নবজাতককে ফেরত দেবেন না। কিন্তু তাদের দাবি করা টাকা জোগাড়ের সামর্থ্য আমাদের নেই।

তিনি আরও জানান, আল-আমিন স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য নবজাতকের মায়ের কাছে এসেছেন। সে স্বাক্ষর না দেওয়ায় কাকে মারধর করতে যান তিনি।

হাসপাতালের বিলের টাকা পরিশোধ করে দিলে সন্তান ফিরিয়ে দেবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে নবজাতকের নানা বলেন, আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা আছে। বাকি টাকা জোগাড় করে নবজাতককে ফিরিয়ে আনার কথা তাদের জানালে, তারা ৭০ হাজার টাকা দাবি করছে। এই ৭০ হাজার টাকা আমাদের পরিশোধের সামর্থ্য নেই।

নবজাতকের মা শিরিন আক্তার বলেন, হাসপাতাল থেকে ছুটির দিন দুপুরে আমাকে ডেকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়। আমি সন্তানকে হাসপাতালের বিছানায় রেখে সেখানে গেলে আমার হাতে ১৫০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ওষুধ কিনে খাওয়ার কথা বলা হয়। আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে আমার সন্তানকে তারা নিয়ে যাবে। আমি ফিরে এসে হাসপাতালের বিছানায় রেখে যাওয়া সন্তানকে আর খুঁজে পাইনি। শেষবারের মতো আমার সন্তানকে তারা দেখতেও দিলো না। এখন আমি আমার সন্তানকে ফেরত চাই।

শামসুন্নাহার জানান, প্রথমে ১৩ হাজার টাকা চুক্তি থাকলেও যেহেতু তার দ্বিতীয় সিজার ছিল তাই তারা পরে বিল বাড়িয়ে দেয়। আর পরিবারটি বিল দিতে না পারায় আল আমিন হাসপাতালের বিল দিয়ে নবজাতককে নিয়ে যান। তবে নবজাতক এখন কোথায় রয়েছে এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

এ বিষয়ে স্বাধীন নার্সিং হোমের পরিচালক মো. খোকন বলেন, ওই নারীর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় তাদের হাসপাতালে। পূর্ব থেকে কত টাকা চুক্তি ছিল তা তাদের জানা নেই। তবে হাসপাতালের বিল হয়েছিল ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। যা পরিশোধ করার পর তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বিল কে দিয়েছে আর নবজাতককে কি করেছে এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।

এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, এমন বিষয়টি আমাদের কেউ এখনো জানাননি। তার কাছে যদি পরিবারটি সহায়তার জন্য আসে অবশ্যই তাদের যথাযথ সহায়তা করা হবে।

আমিনুল ইসলাম/এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।