বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জলিলুর

বিধান মজুমদার
বিধান মজুমদার বিধান মজুমদার , জেলা প্রতিনিধি, শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৫:২২ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

১৯৭১ সালের ২২ মে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। হঠাৎ করে শরীয়তপুরের রুদ্রকর এলাকায় ঢুকে পড়ে অন্তত ৫০ জন পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী। এ সময় বিভিন্ন বাড়ি থেকে তল্লাশি করে নারী ও পুরুষদের ধরপাকড় করে তারা। তাদের সঙ্গে ধরে নেয় হ্যাংলা আর পাতলা গড়নের এক যুবককে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন এই যুবককে দিয়ে তাদের অস্ত্র আর গুলির ভারী বস্তা টানানো শুরু করে। দীর্ঘ পথ বস্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে যখন তিনি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়েন তখন 'ছোকরাকে দিয়ে হবে না' এমন তাচ্ছিল্য আর উষ্মা প্রকাশ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফেরার পথে দেখেন পাকিস্তানিদের গুলিতে রাস্তার উপর পড়ে থাকা নিরীহ মানুষদের নিথর দেহ। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক এদেশে থেকে তাড়াতে হবে শত্রুদের। পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে।

অকুতোভয় গেরিলা সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিলুর রহমানের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইতিহাসটা এমনই। পিতা মোহাম্মদ আলী বেপারী ও মাতা সমত্তমান বিবির একমাত্র সন্তান তিনি। বাবা মোহাম্মদ আলী বেপারী ভারতের ইস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। জলিলুর রহমান যখন তার মায়ের গর্ভে তখন একটি রেল দুর্ঘটনায় মারা যান তার বাবা। এরপর মায়ের কাছেই বেড়ে উঠে তিনি।

১৯৭১ সালে জলিলুর রহমানের বয়স ছিলো ২৫ বছর। একমাত্র ছেলে হওয়ায় মা তাকে যুদ্ধে যেতে দিবেন না। তাই মাকে না জানিয়েই রাতের আধারে একটি হাফ প্যান্ট আর শার্ট গায়ে দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান তিনি। তার সঙ্গে যোগ দেন বন্ধু ইয়াকুব হাওলাদার ও আলী আহম্মেদ সরদারও। এরপর ২৫ জন সহযোদ্ধাসহ বেলুনিয়া বর্ডার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাদের পাঠানো হয় অম্পিনগরের তিতাস ক্যাম্পে। পরে সেখানে তিনি ২৮ দিন অবস্থান করে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি রপ্ত করেন স্টেনগান, এলএমজিসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনা পদ্ধতি।

এরপর আগরতলা হয়ে কুমিল্লার চান্দিনা, বুড়িচং ও দাউদকান্দি হয়ে দিয়ে কখনো পায়ে হেটে আবার কখনো নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ফিরে আসেন শরীয়তপুরে।

দেশে ফিরেই জলিলুর রহমান ও তার সহযোগীরা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের দলে ঢুকতে থাকেন। জলিলুর রহমান ও তার সহযোগীরা শরীয়তপুরের পূর্ব অঞ্চল তথা দামুদর ও গোসাইরহাট অঞ্চলে যুদ্ধ করতেন। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন ১৮ জুলাই দামুদর নদীতে। একটি লঞ্চে করে পাক হানাদার বাহিনী এসে স্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা হামলা চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যরা পানিতে ডুবে মারা যায়। পরে তারা বাধ্য হয় পিছু হঠতে।

১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর আক্রমণে শরীয়তপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরীয়তপুর জেলা মাদারীপুর মহাকুমার অর্ন্তগত থাকায় মাদারীপুরের সঙ্গে মিল রেখে ১০ ডিসেম্বর শরীয়তপুর মুক্তদিবস পালন করা হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিলুর রহমানের বয়স এখন ৭৭ বছর। স্ত্রী ও ৬ সন্তান মিলে তার সংসার। চার মেয়ে রেবেকা, ইলা, ডালিয়া ও আসমার বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জিল্লুর রহমান চাকুরী করেন পুলিশে, আর ছোট ছেলে জিয়াউর রহমান চাকুরি করেন পল্লি বিদ্যুৎ বিভাগে।

জলিলুর রহমান দীর্ঘদিন রুদ্রকর নীল মনি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থতার জটিলতায় অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন তিনি। তবে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন স্বীকৃতি, মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিলুর রহমানের স্ত্রী শাহিনুর বেগম বলেন, আমার স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এটা আমার আর সন্তানদের জন্য গর্বের। তিনি এই দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। মানুষ তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। এটাই আমাদের জন্য বড় পাওয়া।

স্থানীয় বাসিন্দা অপূর্ব দাস বলেন, জলিলুর রহমান আমাদের গর্ব। ছোট বেলা দাদুর কাছে শুনেছি তার বীরত্বের কথা। যতোদিন এই দেশ থাকবে ততোদিন তিনি এই অবদান সবাই মনে রাখবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দেশে ও মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছি। নিজেদের কথা, পরিবারের কথা কখনো ভাবিনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমাদের একটাই চাওয়া, আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভালোভাবে জানতে পারে সেজন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেন শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো বেশি বেশি তুলে ধরেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্টের দায়িত্বে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম মুন্সি জাগো নিউজকে বলেন, জলিলুর রহমান একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি একজন অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

বিধান মজুমদার অনি/এনআইবি/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।