বন্ধুরা যখন খেলতে যায় প্রতিবন্ধী মোহন ছোটে ফুচকা বিক্রিতে

উপজেলা প্রতিনিধি উপজেলা প্রতিনিধি ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশিত: ১০:৫৯ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ফুচকা, চটপটি, চানাচুর আর ঝালমুড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ চালায় প্রতিবন্ধী মো. মিরাতুল ইসলাম মাউন (মোহন)। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ক্লাস করার পর বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফুচকা, চটপটি, চানাচুর আর ঝালমুড়ি বিক্রি করে সে। নিজের আয়ের টাকায় পড়াশুনার পাশাপাশি সংসারেও সহযোগিতা করে।

মোহন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মুনশিদপুর গ্রামের মো. শহিদুল ইসলামের ছেলে ও দাশুড়িয়া এম.এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মোহনের বাম চোখ নষ্ট। এক চোখ নষ্ট ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সে প্রতিবন্ধী কার্ড পেলেও এখনো ভাতা পায়নি। এমনকি স্কুল থেকেও পায় না কোনো সুবিধা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার দাশুড়িয়া হাট এলাকায় ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কের ফুটপাতে সুসজ্জিত ভ্যানে ঝালমুড়ি আর ফুচকা বিক্রি করছে মোহন। শুক্র ও শনিবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে স্কুল ছুটির পর বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সে এখানে ঝালমুড়ি ও ফুচকা বিক্রি করে। মোহনের খাবার মুখরোচক হওয়ায় তার দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী, পথচারী ও সাধারণ লোকজন তার দোকানের ক্রেতা।

বন্ধুরা যখন খেলতে যায় প্রতিবন্ধী মোহন ছোটে ফুচকা বিক্রিতে

মোহনের চাচা মো. আসাদ হোসেন জানান, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মোহন একটি চোখ হারায়। আর্থিক দৈন্যতার কারণে তাকে উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। সে খুব আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মঠ। নিজের আয়ের টাকায় সে পড়াশুনা করে এবং সংসারে সহযোগিতা করে। মোহনরা দুই ভাই এক বোন। অসুস্থতার কারণে মোহনের বাবা কোনো কাজকর্ম করে না। বড় ভাই মেহেদী হাসান রাজিবেরও ফুচকা-চটপটির দোকান রয়েছে। মোহন ও রাজিবের আয় দিয়েই তাদের সংসার চলে।

মোহনের ভাই মো. মেহেদী হাসান রাজিব বলেন, আমাদের ৯ সদস্যের পরিবারে একসময় আমিই একমাত্র উপার্জন করতাম। আমার বাবা এখন আর কোনো কাজ কর্ম করতে পারেন না। আমি ফুচকা, চটপটি, চানাচুর আর ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাই। নিজের খরচ ও পরিবারের চাহিদা মেটাতেই আমার ছোট ভাই পড়ালেখার পাশাপাশি ফুচকা, ঝালমুড়ি ও চটপটি বিক্রি করে।

তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই প্রতিবন্ধী হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো সহযোগিতা করে না। ২ জানুয়ারি মোহন গত বছরের বকেয়া বেতন বাবদ ১৩০ টাকা, সেশন ফি বাবদ ৮০০ টাকা, আইসিটি ফি বাবদ ২০০ টাকা এবং ল্যাব ফি বাবদ ১৫০ টাকাসহ মোট ১২৮০ টাকা পরিশোধ করেছে।

মোহনের বন্ধু বিশ্ব দাস জানায়, মোহন আমাদের সঙ্গে দাশুড়িয়া এম এম উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল ছুটির পর অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমরা যখন খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকি, সেসময় সে ফুচকা, চটপটি, চানাচুর আর ঝালমুড়ি বিক্রি করে। তার একটি চোখ নষ্ট। এটিকে সে তার জীবন চলার পথে কোনো বাধা মনে করে না। সে সঠিকভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র এ ব্যবসা করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। মোহনকে নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করি।

বন্ধুরা যখন খেলতে যায় প্রতিবন্ধী মোহন ছোটে ফুচকা বিক্রিতে

মোহন জানায়, আমি ফুচকা, চটপটি, চানাচুর, ঝালমুড়ি বিক্রি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করি। ২০১৮ সালে দাশুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় টিফিনে বাড়ি যাওয়ার পথে ইঞ্জিনচালিত ভ্যানের ধাক্কায় বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায়। চোখ ভালো করার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে সাধ্যমতো চিকিৎসা নিয়েছি। চোখ ভালো হবে এ স্বপ্ন নিয়ে এখনো চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। ২০২৩ সালে দাশুড়িয়া এম এম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পরিবারের ও নিজের চাহিদা মেটাতে এই ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করি। সরকারিভাবে আমি কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেতনসহ স্কুলের যাবতীয় খরচ দিয়ে পড়াশুনা করছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে ছাড় দেয় না।

দাশুড়িয়া এম এম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আয়ুব আলী বলেন, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মিরাতুল ইসলাম মাউন (মোহন) প্রতিবন্ধী এটা আমার জানা ছিল না। প্রতিবন্ধী, দুস্থ ও অসহায় শিক্ষার্থীদের আমার বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সবসময় সহযোগিতা করি। আর্থিক বা পোশাক বা শিক্ষা সরঞ্জাম দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকি। মোহনের বিষয়ে এখন অবগত হলাম। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে।

দাশুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও দাশুড়িয়া এম এম উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. বকুল সরদার বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়া একজন প্রতিবন্ধীর নাগরিক অধিকার। আমি সমাজসেবা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে তার প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দেবো। স্কুলে যাতে বিনা খরচে লেখাপড়া করতে পারে তার ব্যবস্থাও করা হবে।

ঈশ্বরদী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা খন্দকার মাসুদ রানা জানান, প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগী ৪৫০০ জন। এরমধ্যে শিক্ষার্থী প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী ১৩৪ জন। মো. মিরাতুল ইসলাম মাউন মোহনের প্রতিবন্ধী কার্ড হয়েছে, এখন ভাতার জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারবে। আবেদন করলে বরাদ্দ সাপেক্ষে সে ভাতা পাবে।

শেখ মহসীন/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।