সেন্টমার্টিনে পর্যটকশূন্য কটেজে স্থানীয়দের হাহাকার
চলছে ভরা পর্যটন মৌসুম। বিগত বছরগুলোতে এ সময় পর্যটকে সরগরম থাকতো প্রবাল সমৃদ্ধ দেশের একমাত্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। হেমন্ত ও শীতের কুয়াশা মাখা প্রকৃতিতে সাগরের শান্ত রূপ বিদ্যমান সময় পর্যন্ত চলমান থাকে দ্বীপে পর্যটক আনাগোনা। এ চার মাসের আয়ে চলে বাকি আট মাসের খরচ।
গত দুই দশক ধরে পর্যটনে নির্ভর এই দ্বীপবাসী পূর্ব পুরুষদের পেশা মাছ ধরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে পুরোদমে চাষাবাদও। ফলে ৯০ শতাংশ দ্বীপবাসীর গত এক দশকের আয়ের উৎস পর্যটন সেবা। স্বল্প সময়ে পুরো বছরের আয় জমায় পরিবারের সন্তানরা স্বশিক্ষার পরিবর্তে উচ্চ শিক্ষার আশায় রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরে অবস্থান করে কৃতিত্ব অর্জন করছে। এমনটি দাবি দ্বীপের সচেতন অধিবাসীদের।
তবে গত মৌসুম থেকে দুই দশকের আয়ের উৎস পর্যটন সেবায় প্রতিবন্ধকতা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ আমলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শুরুর আগে অকস্মাৎ দ্বীপে গণহারে পর্যটক আসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের তোড়জোড় শুরু হয়। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য, প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ রক্ষার নামে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বল্প সংখ্যক পর্যটক যাওয়া-আসার উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু বছরে মাত্র চারটি মাস যেহেতু দ্বীপে পর্যটক সমাগম হয় সেহেতু এ চারমাস চাহিদামতো পর্যটক আসুক এবং বাকি আটমাস দ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতিরসমতা রক্ষায় কাজ চলুক- এমন দাবি জানিয়ে আসছিলো দ্বীপবাসী।
সেন্টমার্টিনবাসীর আন্দোলনে বা সরকারে একাদশ সংসদীয় সময়ের শেষ প্রান্ত হওয়ায় পর্যটক সীমিত করণের কাগজে কলমে উদ্যোগ তখন আর নেওয়া হয়নি। কিন্তু বিধিবাম হয়ে দ্বীপে পর্যটনের দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায় মিয়ানমারের রাখাইনে শুরু হওয়া সরকার ও আকারান আর্মির যুদ্ধ। তাদের গোলায় নাফনদ হয়ে চলা ট্রলারে স্থানীয় ও পর্যটক এবং এদেশের সরকারি কর্মজীবীরা আক্রান্ত হওয়ার পর আর অনুমোদন পায়নি টেকনাফ দমদমিয়া ঘাট ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল। অঘোষিত বন্ধ হয়ে যায় কাঠের সার্ভিস বোটও। এতে এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক আসা-যাওয়া।
এরই মাঝে চলতি বছরের শুরুতে চলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করেও অল্প দিনে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। দেশের হাল ধরেন ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আওয়ামী লীগ আমলের নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। নানা দেনদরবার ও প্রতিবাদের পরও নিবন্ধনের মাধ্যমে দৈনিক দু’হাজার পর্যটক দ্বীপে আসার অনুমতি পায়।
মৌসুমের প্রায় দুই মাস পর পহেলা ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে সেই যাত্রা। তিনটি পর্যটকবাহী জাহাজ কক্সবাজার শহর থেকে যাত্রী তুলে দ্বীপে এলেও স্বস্তিতে নেই দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপের ব্যবসায়ী নেতা নুর মোহাম্মদ বলেন, পর্যটনের ক্ষুদ্র ব্যবসায় স্থানীয়রা যুক্ত। অনেকে নিজের ভিটার খালি অংশে ইকো-ট্যুরিজম সিস্টেমে আবাসিক কটেজ ও খাবারের ঘর তৈরি করে পর্যটক সেবা দিয়ে আসছেন। চালিয়ে আসছেন ভ্যান। প্রতিদিন বাড়তি পর্যটক এলে দামি হোটেল-মোটেলের মতো এদের কটেজেও নিত্য পর্যটক মিলতো। আয় ছিল চলমান। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা বাইরের বিত্তশালী ব্যবসায়ী কিংবা আমলাদের স্বজনরা দ্বীপে এসে গড়েছেন বহুতল ভবনে আবাসন। সঙ্গে খুলেছেন আধুনিক রেস্তোরাঁ। এসব হোটেলের সঙ্গে রয়েছে জেলা শহর কিংবা দেশের বিভিন্ন এলাকার দামি হোটেলগুলো কর্পোরেট চুক্তি।
তিনি আরও বলেন, চলতি সময়ে দৈনিক হাতেগোনা যেসব পর্যটক আসছেন তাদের পাশ পেতে বুকিং করা হোটেলের নাম দরকার পড়ায় আগাম বুকিং পাচ্ছে দ্বীপের বহুতল হোটেলগুলো। এতে করে জনশূন্যই থেকে যাচ্ছে স্থানীয়দের কটেজ। ফলে আয়হীনই থাকছে স্থানীয়দের জীবন।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, দ্বীপবাসী কেমন আছেন, তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা কেমন তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না। চলমান তরুণ প্রজন্ম পর্যটনেই আয়ের পথ মাথায় নিয়ে বড় হয়েছে। ফলে তারা অন্য পেশায় হঠাৎ নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে না। তাই দ্বীপের ১০ হাজার মানুষের মাঝে স্বল্প সংখ্যক লোক পুরোনো পেশায় মাছ ধরছে। বাকিদের জীবনধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তাই সরকার বা প্রশাসনের কাছে আমাদের সবার আবেদন প্রকৃতি রক্ষায় নিয়মতান্ত্রিকতা পালন নিশ্চিতের মাধ্যমে মৌসুমের চার মাস পর্যটক সমাগম সহজতর করুন। এতে সংকট উত্তরণ সম্ভব।
এফএ/জিকেএস