নদীর জমি দখল করে বিক্রি, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন

মো. কামরুজ্জামান মিন্টু মো. কামরুজ্জামান মিন্টু , জেলা প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ০৭:৫৯ পিএম, ২২ জানুয়ারি ২০২৫
নদীর জমি দখল করে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন। ছবি-জাগো নিউজ

দখল-দূষণে মরতে বসেছে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খড়িয়া নদী। অথচ ১৫ বছর আগেও নদীতে ছিল স্রোত। জেলেরা সারাবছর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে বর্ষাকাল ছাড়া তেমন পানিপ্রবাহ থাকে না। যে যেভাবে পারছেন দখল করে নিচ্ছেন। অনেকে দখল করা অংশ বিক্রিও করে দিচ্ছেন। তবে এসব ঘটনায় নিষ্ক্রিয় রয়েছে প্রশাসন।

সরেজমিন দেখা যায়, দখল হয়ে গেছে নদীর বিভিন্ন অংশ। এসব জায়গায় বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশের সব আবর্জনা অবাধে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কচুরিপানায় ঢেকে গেছে নদীর পানি।

স্থানীয়রা জানান, এই পানিতে আগে মানুষ নিয়মিত গোসল করতো। গবাদিপশুকেও গোসল করানো হতো। পানিতে জাল ফেললে ছোট-বড় প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে সেই মাছ আশপাশের বাজারে বিক্রি করা হতো। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। নদীর দূষিত পানিতে এখন আর কেউ গোসল করেন না। জেলেরা কোনোদিন মাছ ধরতে জাল ফেললে সারাদিনের চেষ্টায় যৎসামান্য ছোট মাছ ধরা পড়ে। পৌরশহরের সেতুর দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বহুতল ভবন।

jagonews24

অনেক জায়গায় করা হয়েছে ফসলের আবাদ। সিএস রেকর্ডে নদীর জায়গা থাকলেও আরওআর এবং বিআরএস খতিয়ান রেকর্ডে দখলসূত্রে নিজেদের নামে দলিল করে নিয়েছেন অনেকে। সেই জমি আবার অন্যের কাছে বিক্রিও করা হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয়রা প্রশাসনকে বারবার জানালেও ফলাফল শূন্য।

পৌর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময়ের উত্তাল খড়িয়া নদী এখন স্রোতহীন। ধীরে ধীরে দখলের কারণে নদীটি এখন সংকীর্ণ হয়ে গেছে। প্রত্যেকে তার বাড়ির সামনের নদীর অংশ দখল করে আবাদ করছেন। এসব জমি অনেকে বিক্রিও করছেন। তারা কীভাবে কাগজপত্র করে এসব করছেন, তারাই ভালো জানেন।’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে খড়িয়া নদীর পাড়ে চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন। নদীর পাড়ঘেঁষে বাড়ি নির্মাণ করেছেন আব্দুল খালেক নামের আরও একজন। যে কেউ দেখলে বলবেন সেটি নদীর মধ্যে পড়েছে। তাদের মতো আরও অনেকে নদীর জায়গা দখল সূত্রে কাগজপত্র করে বেচাকেনা করছেন।

স্থানীয় বিল্লাল হোসেন বলেন, সেতুর নিচে খড়িয়া নদীর অংশটুকু ‘মেন্দুমিয়ার চর’ নামে পরিচিত। সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য এ অংশ লিজ নিয়েছেন চৌকিদার কুদ্দুস। পরে তিনি বিআরএস খতিয়ানে নিজের নামে লিখে নেন। এখন প্লট করে বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা হাতাচ্ছেন।

দখল-দূষণে মরতে বসেছে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খড়িয়া নদী। অথচ ১৫ বছর আগেও নদীতে ছিল স্রোত

এ বিষয়ে জানতে চৌকিদার কুদ্দুসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ক্রয়সূত্রে আড়াই শতাংশ জমি কিনে বাসা নির্মাণ করেছি। এটি নদীর জায়গা না।

একই বক্তব্য দিয়ে নদীর পাড়ঘেঁষে বাসা নির্মাণ করা আব্দুল খালেক বলেন, ‘সরকারি লোকজন এসে মাপজোক করুক। আমি নদীর জায়গা দখল করিনি। আমার হাতে দলিলপত্র রয়েছে।’

সেতুর পাশে নদীর ওপর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অনেক দোকান। দোকানি রাজু মিয়া বলেন, ‘সেতুর পাশে বাপ-দাদা ব্যবসা করেছে। আমিও দোকান করছি। এ ব্যবসায় লাভের টাকা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করি। দোকান সরিয়ে দিলে কর্মহীন হয়ে পড়বো।’

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলায় ৫৯টি নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ কিলোমিটার খড়িয়া নদী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রাংসা থেকে ফুলপুর উপজেলা অতিক্রম করে হালুয়াঘাটের ভোগাই কংস নদে গিয়ে মিশেছে। নদীটির বেশিরভাগ অংশ ফুলপুরে হওয়ায় এটি ‘ফুলপুর খড়িয়া নদী’ হিসেবে পরিচিত। নদী সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হয়। সেখানে অনেকের জায়গা-জমি থাকলেও আমাদের কিছু করার নেই। নদী খননের সময় সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খনন করা হবে।

দখল-দূষণে মরতে বসেছে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খড়িয়া নদী। অথচ ১৫ বছর আগেও নদীতে ছিল স্রোত

ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম সীমা বলেন, নদী সুরক্ষায় আইন রয়েছে। কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দখল-দূষণে জড়িত থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখলাক উল জামিল বলেন, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় জেলায় ছোট-বড় ২১টি নদী ও খাল খনন করা হয়েছে। বর্তমানে মুক্তাগাছার আয়মন নদীর খননকাজ অব্যাহত রয়েছে। নান্দাইলের কাঁচামাটিয়া নদীর খননকাজ অচিরেই শুরু হবে। জনগণের দাবি বিবেচনা করে ফুলপুরের খড়িয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।