শুধু শ্রম নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে চাই

ইব্রাহীম হুসাইন অভি
ইব্রাহীম হুসাইন অভি ইব্রাহীম হুসাইন অভি
প্রকাশিত: ০৮:১৭ এএম, ৩০ জুন ২০২৫

দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে শুরু থেকেই নারী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। কিন্তু এত বছরের পরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তাদের অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। এই বৈষম্য দূর করে নারী কর্মীদের উচ্চপর্যায়ের পদে উন্নীত করার এখনই সময়। এ শিল্পের বিকাশে নারীরাই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। এখন সময় এসেছে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নিয়ে আসার।

নেতৃত্বে নারীর সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিত না হলে এ খাতের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমি চাই নারী শ্রমিকরা ম্যানেজমেন্ট লেবেলে আসুক, তারা নেতৃত্ব দিক।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম নারী সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার ভিদিয়া অমৃত খান জাগো নিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা ইব্রাহীম হুসাইন অভি

ভিদিয়া অমৃত খান বলেন, নারী শ্রমিকদের অগ্রগতিতে আমি বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বিজিএমইএর বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করবো এবং আশা করি সবাই সমস্বরে সেটা গ্রহণ করবেন।

ভিদিয়া অমৃত খানের বাবা মরহুম এম. নূরুল কাদির খান, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের পথপ্রদর্শক। তিনি ১৯৭৮ সালে দেশের প্রথম শতভাগ-রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন।

জাগো নিউজ: প্রথমবারের মতো বিজিএমইএতে আপনারা পাঁচজন নারী পরিচালক হয়েছেন এবং আপনি সহ-সভাপতি। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ভিদিয়া অমৃত খান: আমি মনে করি এটা আমার দীর্ঘ পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি। বিজিএমইএর আশপাশে আমি প্রায় ১৫ বছর কাজ করেছি। আমার প্রথম নির্বাচন ছিল ২০১১ সালে। এতদিনে আমি বোঝাতে পেরেছি যে আমি শুধু নামেই প্রার্থী নই, বাস্তবে কাজ করি। এবার পাঁচজন নারী বিজয়ী হয়েছেন, যা একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড। আমি মনে করি, এটা আমাদের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে একটি বড় ধাপ।

শুধু শ্রম নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে চাই

এই (পোশাক) খাতটি নারী শ্রমিকনির্ভর। একসময় প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিকই ছিলেন নারী, এখন তা ৬৫ শতাংশের মতো। তাই নেতৃত্বেও নারীদের থাকা জরুরি। এটা শুধু প্রতীকী কিছু নয়। কাজের ক্ষেত্রেও নারীরা প্রমাণ দিচ্ছেন যে তারা আন্তরিক, দক্ষ এবং দায়িত্বশীল।

জাগো নিউজ: আপনি কী ধরনের পরিবর্তন আনতে চান, বিশেষ করে শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে?

ভিদিয়া অমৃত খান: শুধু একা আমি না—আমাদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। নারী কর্মীদের জন্য আরও ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমি চাই, তারা সুপারভাইজার, মিড ও টপ ম্যানেজমেন্টে আসুক। তারা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বুঝে এবং দায়িত্বশীলভাবে কাজ করে।

আমি আগে থেকেই এমন কিছু প্রকল্পে কাজ করেছি যেখানে গার্মেন্টস বর্জ্য শিল্পে নারীরা যুক্ত ছিলেন। আমরা ‘সুইট টু সিটি’ প্রকল্পে কাজ করেছি, যেখানে পরিবেশ, শ্রমিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছি। অটোমেশন আসছে, নারীদেরও সেই অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে কাজ করতে চাই। শ্রমিকদের বাচ্চাদের জন্য স্কুল গড়ার পরিকল্পনা আছে—সরকার যদি সাহায্য করে তবে তা আরও দ্রুত হবে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে পোশাক খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শুধু শ্রম নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও নারীকে এগিয়ে আসতে হবে।

জাগো নিউজ: এই পাঁচজন নারী উদ্যোক্তার বিজয় কি পুরুষ নেতৃত্বের মধ্যে মানসিকতার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়?

ভিদিয়া অমৃত খান: অবশ্যই। এই ভোট দিয়েছেন গার্মেন্টস মালিকরাই। তারা বুঝেছেন, এখন সময় এসেছে নারী নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসার। আমাদের অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠানে প্রধান হিসেবে কাজ করছি, কেউ বাবার ব্যবসা চালাচ্ছি, কেউ নিজের তৈরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছি। আমরা কারও ওপর নির্ভরশীল নই, বরং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, নেতৃত্ব দিচ্ছি।

জাগো নিউজ: বৈশ্বিক ক্রেতাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আপনি কী বার্তা দিতে চান?

ভিদিয়া অমৃত খান: বৈশ্বিক ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে বলব—তোমরা কমপ্লায়েন্স চাও, অথচ প্রাইস কমাও! ফ্রিতে কিছুই হয় না। কমপ্লায়েন্স বজায় রাখতে খরচ হয়, ট্রেনিং লাগে, এনভায়রনমেন্টাল মান রাখতে ইনভেস্ট করতে হয়। তাই বায়ারদের উচিত আমাদের সাপোর্ট করা। আমরা গ্রিন ফ্যাক্টরি বানাচ্ছি, সার্কুলারটি আনছি, রিসাইক্লিং করছি—এসব টেকসই উদ্যোগের পেছনে তোমাদেরও দায়িত্ব আছে।

জাগো নিউজ: আপনার নারী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কোনো বার্তা?

ভিদিয়া অমৃত খান: আমি বলব, আপনারা অসাধারণ। আপনারা এ শিল্পের মূল ভিত্তি, আপনাদের ছাড়া এ খাত চলতে পারে না। সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেন। অনেকেই নিজের সন্তানকে ফেলে, একা থেকে কাজ করেন। আমি চাই, আপনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও খোলামেলা হোক। আমি এমন উদ্যোগ নিতে চাই যাতে ওয়ার্কারদের সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হয়। স্কুল করা যায় যাতে তারা মানসম্মত শিক্ষা পায়। শিক্ষাই পারে প্রজন্ম বদলে দিতে।

তাই কেবল শ্রম নয়, এখন সময় এসেছে নেতৃত্বেও নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন, নিজের কণ্ঠস্বর তুলে ধরুন। কর্মক্ষেত্রে সম্মান, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ পরিবেশ—এ সবই আপনাদের প্রাপ্য, অনুগ্রহ নয়। আমি চাই প্রতিটি নারী শ্রমিক নিজের সক্ষমতাকে বিশ্বাস করুক এবং আগামী দিনে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হোক। নারী এগোলে সমাজ এগোয়, শিল্পও এগোয়।

জাগো নিউজ: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কী ভাবছেন?

ভিদিয়া অমৃত খান: নারী উদ্যোক্তারা এখনো ব্যাংকিং সিস্টেমে পিছিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিমেল ফান্ড থাকলেও খুব কম সংখ্যক আবেদনকারীর লোন পাস হয়। কারণ আজও একজন নারীকে লোন নিতে হলে জামাই বা ভাইকে গ্যারান্টার বানাতে হয়। কেন? আমি কেন আমার মা, বোন বা ফ্রেন্ডকে গ্যারান্টার বানাতে পারবো না? নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্পেশাল ইন্টারেস্ট রেট, স্পেশাল ব্যাংকিংসেবা দরকার।

একজন নারী উদ্যোক্তা যদি ১০ মিলিয়ন ডলারের এক্সপোর্ট করতে পারে, তবে তার স্পেশাল কিছু না লাগলেও, যারা শুরু করছে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা থাকা উচিত। এই ‘তুমি তো মেয়েমানুষ’—এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমি ছোটবেলায় বোর্ডিং স্কুলে পড়েছি, বাবার কাছ থেকে কখনো ফিমেল বলে কম কিছু পাইনি। এমন শিক্ষাই দরকার, যাতে মেয়েরা নিজের অবস্থান নিজেই তৈরি করতে পারে।

আইএইচও/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।