বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি-করহার দরকার

ইব্রাহীম হুসাইন অভি
ইব্রাহীম হুসাইন অভি ইব্রাহীম হুসাইন অভি
প্রকাশিত: ০৮:৩৬ এএম, ১৫ মে ২০২৫
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইউবিএল) চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার

নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকারকে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে একটি পূর্বানুমানযোগ্য করনীতি এবং স্থিতিশীল করপোরেট করহার প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি একটি অনুকূল ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে চলমান সংস্কারগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইউবিএল) চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার আগামী বাজেট নিয়ে তার প্রত্যাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে জাগো নিউজকে এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ প্রতিবেদক ইব্রাহীম হুসাইন অভি।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

আশা করি আগামী বাজেটে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ একটি সুন্দর ব্যবসায়িক পরিবেশ দেবে, যা ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে না। তবে, কিছু বিষয় আছে যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

আমাদের প্রচলিত ধারণা শুল্ক বিভাগের কাজ হলো কর আদায় করা। মূলত শুল্ক বিভাগের প্রধান কাজ ব্যবসা পরিচালনা আরও সহজ করার লক্ষ্যে আমদানি পণ্যের দ্রুত ও ঝামেলাহীন খালাস নিশ্চিত করা

প্রথমত, দেশে পরোক্ষ কর অনেক বেশি। আমাদের বেশি প্রত্যক্ষ করের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, এটি কর ফাঁকি ও দুর্নীতি বন্ধ করে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের ভ্যাট ব্যবস্থা খুবই জটিল। একটি সমন্বিত বা একক ভ্যাটহার কীভাবে প্রবর্তন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আমাদের একটি পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রয়োজন, যা পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে। এটি সব খাতের জন্য একটি একক ঐক্যবদ্ধ ভ্যাটহার প্রবর্তন করতে সাহায্য করবে। এটা করা গেলে কর আদায় বাড়বে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধাজনক হবে।

বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি-করহার দরকার

তৃতীয়ত, আমাদের প্রচলিত ধারণা শুল্ক বিভাগের কাজ হলো কর আদায় করা। মূলত শুল্ক বিভাগের কাজ হলো কর আদায় প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করা। শুল্ক বিভাগের প্রধান কাজ ব্যবসা পরিচালনা আরও সহজ করার লক্ষ্যে আমদানি পণ্যের দ্রুত ও ঝামেলাহীন খালাস নিশ্চিত করা।

চতুর্থত, একটি ডিজিটাল কর সংগ্রহ পদ্ধতি তথা ইকোসিস্টেম তৈরি করা। এই পদ্ধতিতে একাধিক প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে নিজস্ব তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারবে। যাকে বলা যায় ইন্টারঅপারেবল। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ পরিমাপ করতে পারে যে একজন ব্যবসায়ী কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করেন এবং এর ওপর কর বা ভ্যাট কত। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি স্বচ্ছ তথ্য দেয়। সুতরাং, ডিজিটাল কর সংগ্রহ পদ্ধতি কার্যকর করতে পদক্ষেপ দরকার।

পঞ্চমত, যথাযথভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য আমাদের সামগ্রিক পরিচালনার মান ও শ্রম অধিকার উন্নত করতে হবে।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাজেটে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?

একজন বিনিয়োগকারী যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কার কাছ থেকে বিনিয়োগ পরিষেবা নেবেন- বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ নাকি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের। একাধিক কর্তৃপক্ষ ও সংস্থার কারণে প্রক্রিয়া জটিল হয়। বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি একক ও সমন্বিত কর্তৃপক্ষ থাকা অত্যাবশ্যক, যাতে তারা সহজে ও কার্যকরভাবে সেবা পেতে পারেন।

আমরা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পরবর্তী বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি এবং হার আশা করছি, যা বিনিয়োগের আস্থা জাগাবে। যখন একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন পেতে কত বছর সময় লাগবে তা মাথায় রেখে

যদি চার-পাঁচটি আলাদা সংস্থার মাধ্যমে অনুমোদন বা পরিষেবা নিতে হয়, তাহলে তা শুধু জটিলতা বাড়ায় না, বরং বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ভারত বা কোরিয়ায় বিনিয়োগ করতে যান, সেখানে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেবা রয়েছে, যা বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করে তোলে।

একটি পূর্বাভাসযোগ্য করহার এবং নীতি কেন প্রয়োজন?

আমরা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পরবর্তী বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি এবং হার আশা করছি, যা বিনিয়োগের আস্থা জাগাবে। যখন একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, তখন বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন পেতে কত বছর সময় লাগবে তা মাথায় রেখে। তাই বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য করনীতি এবং হারের পূর্বাভাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি-করহার দরকার

যদি করহার বা নীতি নিয়মিত পরিবর্তন করা হয়, তাহলে বিনিয়োগের ব্যয় বাড়ে এবং বিনিয়োগের রিটার্ন দীর্ঘায়িত হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা এমন বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল খোঁজেন যেখানে একটি স্থিতিশীল ও পূর্বাভাসযোগ্য করহার এবং নীতি থাকবে।

৫ আগস্টের আগের তুলনায় এখন বিনিয়োগকারীদের আস্থা কেমন?

বর্তমান প্রেক্ষাপট বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের সেবার মান উন্নয়ন করেছে। তারা আরও কিছু করার চেষ্টা করছে, যা ইতিবাচক। নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কিংবা নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বিষয় অনিশ্চয়তা।

বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের প্রবল প্রয়োজন, যা ট্রেড পলিসির জন্য একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে। একজন বিনিয়োগকারী সর্বদা একটি স্থিতিশীল নির্বাচিত সরকার চায়। কে ক্ষমতায় আসুক তাতে কিছু যায় আসে না

তাদের মনে প্রশ্ন হলো কে ক্ষমতায় আসবে? যদি একজন বিনিয়োগকারী জানেন যে এই সরকার আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে, তাহলে তারা মনে করেন তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ। যদি তারা পরবর্তী সরকার সম্পর্কে নিশ্চিত না হন, তাহলে তারা বিনিয়োগ করতে অনিরাপদ বোধ করেন।

বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের প্রবল প্রয়োজন, যা ট্রেড পলিসির জন্য একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে। একজন বিনিয়োগকারী সর্বদা একটি স্থিতিশীল নির্বাচিত সরকার চায়। কে ক্ষমতায় আসুক তাতে কিছু যায় আসে না। তবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের জন্য একটি নির্বাচিত ও স্থিতিশীল সরকার থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্কার নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

বিনিয়োগ আকর্ষণ কিংবা দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সংস্কার জরুরি। আগস্ট অভ্যুত্থানের পর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ কিছু সংস্থা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। ব্যবসায়ীদের সেবার ক্ষেত্রে অনেক কাজ করা হয়েছে, এগুলো টেকসই করতে হলে এটিকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইতোমধ্যে বিদ্যমান সংস্কার উদ্যোগগুলো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। সংস্কারের বিরোধিতা থাকবে, তবে আমাদের সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংস্কার হলো একটি শিশুর জন্মের মতো, আপনি মাঝখানে বেরিয়ে আসতে পারবেন না, তবে ফলাফল ভালো হবে। আমাদের সংস্কার উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়। বরং এটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে আগামী বাজেটে পদক্ষেপ থাকা জরুরি।

বর্তমানে কী সমস্যা দেখছেন যা বিনিয়োগের পথে অন্তরায়?

বড় সমস্যা হলো আমাদের প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে এটি প্রমাণ করতে হবে। আগস্টের পরে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমবেশি ফিরেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি ব্র্যান্ডের কিছু দোকানে হামলা ও জনতার বিচারের ঘটনা আস্থা নষ্ট করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদিও দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এটা আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।

বড় সমস্যা হলো আমাদের প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে এটি প্রমাণ করতে হবে। আগস্টের পরে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমবেশি ফিরেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি ব্র্যান্ডের কিছু দোকানে হামলা ও জনতার বিচারের ঘটনা আস্থা নষ্ট করেছে

উন্নত বিনিয়োগ পরিবেশের পাশাপাশি আমাদের ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের আচরণের মাধ্যমে বোঝাতে হবে যে এখানে তাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিরাপদ।

বিনিয়োগ আকর্ষণে বাজেটে একটি দূরদর্শী করনীতি-করহার দরকার

কার্যকর কর নিয়েও জটিলতা রয়েছে?

এনবিআর চেয়ারম্যানও বলেছেন, যে তারা করের হার কমান। কিন্তু এখানে ইফেক্টিভ ট্যাক্স রেট (কার্যকর করহার) বেশি। এটা তারা জানেন। বিগত কয়েক বছরে করপোরেট হার অনেক কমানো হয়েছে। কিন্তু কার্যকরী কর হয়ে যায় ৪৫ শতাংশ। এর কারণ অস্বীকৃতি। বিবেচনামূলক কিছু থাকা উচিত নয়। কী অনুমোদন দেওয়া যাবে, কী দেওয়া যাবে না- এটা আছে। কিন্তু এর মধ্যে যদি বিবেচনামূলক কিছু থাকে সেটা সরিয়ে দিতে হবে। দিন শেষে কোম্পানিগুলো দেখে তারা কার্যকরভাবে কতটুকু পরিশোধ করলো।

আরেকটি বিষয় ভূতাপেক্ষা কর। এটি অনেক কঠোর ও ভয়ংকর। এটি ব্যবসা ও ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর। আপনাকে যদি এখন বলে আপনার করের হার বেড়ে গেছে, আপনি তো খরচ করে ফেলেছেন। যদি গত এক বছরের হিসাব টান দেয় তাহলে সেটা ব্যক্তির জন্য দুশ্চিন্তার। কোম্পানির জন্য এখানে তো আমি আমার ফিন্যান্স বন্ধ করে দিয়েছি, ডিক্লেয়ার্ড করে দিয়েছি- তারপর বলছেন গত এক বছরের আয়ের ওপর দিতে হবে। এগুলো দুনিয়ার কোথাও হয় না।

আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।