শুল্কের অজুহাতে মালিকরা যেন শ্রমিকদের বেতন না কমান

জেসমিন পাপড়ি
জেসমিন পাপড়ি জেসমিন পাপড়ি , কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩২ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর অনেক দরকষাকষির পর শেষ পর্যন্ত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই শুল্কহারকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পোশাক কারখানার মালিকরা যাতে শ্রমিকদের মজুরি না কমিয়ে দেন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ শুল্কহার কেবল বাংলাদেশ নয়, আমাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশের ওপরও এসেছে। ফলে এটিকে একতরফাভাবে লোকসানজনক না ভেবে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার কৌশল নির্ধারণ জরুরি।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রভাব কোনোভাবে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ওপর পড়বে কি না?

ড. ইমতিয়াজ: এখন দেখার বিষয় হলো—এই ২০ শতাংশ শুল্কে আমরা ভিয়েতনাম, তুরস্ক বা ভারতের মতো প্রতিযোগীদের সঙ্গে লোকসান না করে টিকে থাকতে পারি কি না। শ্রমিকদের মজুরি না কমিয়ে আমরা বাজার ধরে রাখতে পারছি কি না সেটাই আসল প্রশ্ন।

যদি আমার শুল্কহার প্রতিযোগী দেশের কাছাকাছি হয়, তাহলে আমরা কোনো বড় ক্ষতির মুখে পড়ছি না। এই শুল্ক নিয়ে যে ‘হইচই’ তা আসলে অন্য কিছু পাওয়ার বা দেখানোর কৌশলও হতে পারে

অনেক মালিক আছেন, যারা শুল্কের অজুহাতে শ্রমিকের বেতন কমিয়ে দেন। অথচ নিজেরা মুনাফা করছেন এবং সেই মুনাফার অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা যুক্তরাজ্যে সেই টাকায় পরিবার নিয়ে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন, আর শ্রমিক রয়ে যাচ্ছেন অনিশ্চয়তায়।

শ্রমিকদের ওপর আরও কাজ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না সেটার নজরদারি এখন সবচেয়ে জরুরি। এই সংকটকালীন গভর্ন্যান্সকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি সরকার যেন শুল্কের অজুহাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাজেট কমিয়ে না দেয়, এটাও নিশ্চিত করতে হবে।

জাগো নিউজ: প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপরও শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?

ড. ইমতিয়াজ: প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখনো এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখনো পাকিস্তানের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমাদের শ্রমিকরা এখনো এমন মজুরিতে কাজ করেন, যাতে আমরা আরও এক-দুই দশক প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য রপ্তানি করতে পারবো। আমাদের আছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এবং বিপুল নারী শ্রমিক, যা পাকিস্তানের নেই। এটাই আমাদের শক্তি।

পণ্যে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। যে কোনো চুক্তির আগে উচিত ছিল ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আলোচনা করা। আমরা তা না করে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে নানান ঘোষণা দিয়ে ফেলেছি

জাগো নিউজ: এ সম্ভাবনাকে বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাতে পারে?

ড. ইমতিয়াজ: এ সম্ভাবনা আরও কার্যকর করতে হলে শিল্প বৈচিত্র্য জরুরি। এত বছরেও কেন আমরা শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই আটকে আছি? কেন মালিকরা কৃষি, প্রযুক্তি, হেলথ টেক, রিনিউয়েবল এনার্জির মতো নতুন খাতে বিনিয়োগ করছেন না?

এ পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের উচিত মালিকপক্ষের ওপর আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও জীবনমান রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া। শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।

জাগো নিউজ: ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের জন্য আকস্মিক ছিল কি না?

ড. ইমতিয়াজ: ট্রাম্প নির্বাচনের আগে থেকেই বলেছিলেন, ট্যারিফ বাড়াবেন। তারা মনে করেন, বিদেশি পণ্যে কম শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ট্যারিফ থেকে মুনাফা তুলে তা পূরণ করাই তাদের লক্ষ্য। যদিও দেশেটির অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, এটা টেকসই নয়। কিছুদিন কাজ দেবে, পরে আর লাভ হবে না।

আমাদের দেখতে হবে—যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের ওপরও শুল্ক দিয়েছে। যদি আমার শুল্কহার প্রতিযোগী দেশের কাছাকাছি হয়, তাহলে আমরা কোনো বড় ক্ষতির মুখে পড়ছি না। এই শুল্ক নিয়ে যে ‘হইচই’ তা আসলে অন্য কিছু পাওয়ার বা দেখানোর কৌশলও হতে পারে।

কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত থাকা আন্তর্জাতিক কূটনীতির কাঠামোয় পড়ে না। চীন জাতিসংঘের সদস্য, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাদের বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থাকাটা স্বাভাবিক

হয়তো এই হইচইয়ের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দেখাতে চায়—বিশ্বব্যবস্থাকে এখনো আমেরিকাই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বাস্তবতা বদলে গেছে। সেই এক মেরু বিশ্ব এখন আর নেই।

জাগো নিউজ: এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে কতটা প্রস্তুত ছিল বলে মনে করেন?

ড. ইমতিয়াজ: আমাদের এলিট পলিসি মেকাররা কেন এ পরিবর্তনটা বুঝতে পারছেন না, জানি না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাও জানে, শুধু শক্তির জোরে এখন আর বিশ্ব রাজনীতি বা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

শুল্ক সংকটকে কেবল সমস্যা হিসেবে না দেখে সুযোগ হিসেবেও দেখা দরকার। নতুন মার্কেট খোঁজা দরকার। পণ্যে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। যে কোনো চুক্তির আগে উচিত ছিল ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আলোচনা করা। আমরা তা না করে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে নানান ঘোষণা দিয়ে ফেলেছি।

যদি আমেরিকার দিকে বেশি ঝুঁকে যাই, তাহলে তারা আমাদের দুর্বলতা কাজে লাগাতে পারে। তবে আজ না হয় কাল, জনগণ-নির্বাচিত সরকার আসবে। তখন জনগণের মতই হবে মুখ্য।

জাগো নিউজ: শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক অধিকার, মেধাস্বত্ব বিষয়ক শর্তগুলো কৌশলগত চাপের অংশ কি না?

ড. ইমতিয়াজ: এগুলোর মাধ্যমে তারা চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এটি তাদের একটি চিরাচরিত কূটনৈতিক কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের যারা ব্যবসা করে, তাদের মূল লক্ষ্য মানবাধিকার নয়—মুনাফা। পুঁজিবাদের মূলমন্ত্রই হলো লাভ, মানবিক মূল্যবোধ নয়, মানবাধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেটার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। যদি মানবাধিকারই তাদের অগ্রাধিকার হতো, তাহলে এই সময়ে এসেও গাজায় চলমান গণহত্যা হতো না।

যুক্তরাষ্ট্র যখন অন্য দেশের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, সেটা বাস্তব আন্তরিকতা নয়, বরং চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার। এটি দুঃখজনক যে কখনো কখনো যুক্তরাষ্ট্র বলছে বলেই শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করতে যাই। অথচ এটি আমাদের নিজেদের দায়িত্ব, নিজেদের প্রয়োজনেই তা নিশ্চিত করা উচিত।

জাগো নিউজ: চীনের লগইংক ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কথা শোনা যায়। এটা কতটুকু যৌক্তিক?

ড. ইমতিয়াজ: কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত থাকা আন্তর্জাতিক কূটনীতির কাঠামোয় পড়ে না। চীন জাতিসংঘের সদস্য, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাদের বিস্তৃত সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থাকাটা স্বাভাবিক।

জাগো নিউজ: শুল্ক বিষয়ক দরকষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়লো কি না?

ড. ইমতিয়াজ: বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়েন এবং সেই সূত্রে কিছু সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেন, সেটা তাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা থেকেই আসে। বিশেষ করে, সরকার যখন নির্বাচিত নয় বা গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই দুর্বলতার সুযোগ অন্যরা নিতে চায়।

জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।