আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির ঘোষণা আসছে

মেসবাহুল হক
মেসবাহুল হক মেসবাহুল হক , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৪২ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২০

গত বছর কোরবানি পশুর চামড়ার নজিরবিহীন দর বিপর্যয়ের পর কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। তবে এবার যেন কিছুটা দাম পাওয়া যায়, সেজন্য ওয়েট-ব্লু লেদার বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী রোববার (২৬ জুলাই) চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে গতবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কথা রাখেনি। গরিব ও এতিমদের হক চামড়ার দাম নিয়ে গত বছরের কারসাজি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ৩১ বছরের মধ্যে গতবার কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়ার দরে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে আসে। দাম না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভে চামড়া নদীতে ফেলেও দেন

‘তাই গত বছর কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু নানান চাপে সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এবার কী করা যায় সে বিষয়ে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে কাজ করতে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশন কাঁচা চামড়া রফতানি করার পক্ষে মত দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওয়েট-ব্লু লেদার বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা আগামী রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেবেন। তবে প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ চামড়া রফতানির ঘোষণা দেয়া হবে’– বলেন ওই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, কী পরিমাণ ও কী ধরনের চামড়া রফতানি করার অনুমতি দেয়া হবে সেসব ঠিক করে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে আলাপ করলে তিনি কাঁচা চামড়া সরাসরি রফতানির কথা না বললেও এ বছর কোরবানি পশুর চামড়ার যেনো উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য সরকার সবকিছু করছে বলে জাগো নিউজকে জানান। মন্ত্রী বলেন, বিগত দিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চামড়া সংগ্রহের জন্য এবার কোনো অর্থ সংকট থাকবে না। প্রয়োজনে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়টিও মাথায় রেখেছে।

Finshed-Leather

চামড়ার দর সম্পর্কে তিনি বলেন, গত বছরের মতো পরিস্থিতি কোনো অবস্থাতেই হতে দেয়া হবে না। এ বছর কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ
এদিকে তিন দশক ধরে কাঁচা চামড়া রফতানির যে সুযোগ বন্ধ রয়েছে, সম্প্রতি তা খুলে দেয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলেছে, এবার ঈদুল আজহায় পশুর কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে রফতানির সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

সূত্র বলছে, কমিশন গত বছরের অভিজ্ঞতায় এবার এই সুপারিশ করেছে। গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশের চামড়ার একটি অংশ পচে যায়। এর বড় কারণ ছিল চামড়া কিনতে অনীহা। দেশের চামড়া প্রক্রিয়াকারী ট্যানারি মালিকেরা গত বছর চামড়া কেনার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত টাকা ছাড়েননি। এক্ষেত্রে তারা ব্যাংক ঋণ না পাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। চাহিদা কম থাকায় দামও তলানিতে নেমে যায়। অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। অনেক জায়গায় বাড়তি দামে লবণ কিনে সংরক্ষণ না করায় পচে যায়। এবারও পরিস্থিতির উন্নতির তেমন কোনো আশা নেই।

এমন পরিস্থিতিতে ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হোক। গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার নির্ধারিত দর ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এবার কমিশন তা ৩০ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া ছাগলের চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকার জায়গায় ১৫ থেকে ২৫ টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে কমিশনের প্রস্তাবে।

কমিশনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি হতো, সেখানে এখন সিনথেটিক বস্ত্র ও কৃত্রিম চামড়ার ব্যবহার বেড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী চামড়ার দাম কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ সেন্ট থেকে দেড় মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম দাঁড়ায় ৪৩ থেকে ১২৯ টাকা।

আংশিক চামড়া বা কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা খুশি হলেও উদ্যোক্তারা শঙ্কিত। এ বিষয়ে লালবাগের পোস্তার আড়তদার সমিতি বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. হুমায়ন জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ওয়েট ব্লু লেদার বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানি বন্ধ রয়েছে। এরপর থেকে চামড়া শিল্পে দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশে ওয়েট ব্লু লেদার ৪০ ভাগ, ক্রাস্ট চামড়া ৪০ ভাগ এবং ২০ ভাগ ফিনিশড লেদার রফতানি চালু করতে পারলে আবারও চামড়ায় সুদিন ফিরবে।

Finshed-Leather

তবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, সরকার যদি কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেয় তা হবে আত্মঘাতী। যা হুমকি হয়ে দেখা দেবে পুরো চামড়া খাতের জন্য। কারণ রফতানি হলে দেশের ট্যানারিগুলো আগামীতে চামড়া সংকটে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যাবে। দেশের একটা সম্ভাবনাময় খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।

জানা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে চামড়া খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য ধরে ২০১৭ সালে চামড়াশিল্পকে ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল সরকার।

কিন্তু রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ মার্কিন ডলার। পরের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর পরের বছর (২০১৭-১৮) এই খাত থেকে রফতানি আয় ১২ শতাংশ কমে যায়, আসে ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ কমে রফতানি আয় দাঁড়ায় ১০১ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে।

সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭ শতাংশ কম এবং আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২২ শতাংশ কম। গত অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১০৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এমইউএইচ/এইচএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।