সেমাইয়ের বাজার দখল করেছে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো
ঈদুল ফিতরে অতিথি আপ্যায়নের বড় অনুষঙ্গ সেমাই। এমনকি ঈদের সকালটিও শুরু হয় সেমাই মুখে দিয়েই। ফলে ঈদে নতুন জামা-কাপড় কেনা শেষে সবাই ছোটেন সেমাই-চিনির দোকানে। আসছে ঈদুল ফিতর ঘিরে সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সেমাইয়ের দোকান ঘিরে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
তবে দেশের বাজারে হাতে তৈরি সেমাইয়ের কদর এখন অনেক কম। সে জায়গা দখলে নিয়েছে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডের সেমাই। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে বাজারে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বাজারে এখন প্যাকেটজাত সেমাই ছাড়াও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি, কিশমিশ, বাদাম, মসলা, দারুচিনি, এলাচি, গুঁড়ো ও তরল দুধ বিক্রি হচ্ছে।
বছরজুড়ে দেশে কত টাকার সেমাই বেচাকেনা হয়, এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ব্যবসায়ীদের ধারণা, বছরে অন্তত দেড়শো কোটি টাকার সেমাইয়ের চাহিদা রয়েছে ভোক্তাদের। যেখানে বাজারে অর্ধেকের বেশি সেমাই সরবরাহ করে প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডগুলো। বছরে যে পরিমাণ সেমাই বিক্রি হয় এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হয় ঈদুল ফিতর ঘিরে।

প্যাকেটজাত সেমাই উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সংগঠনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে। আগে শুধু ঈদে সেমাই খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এখন বছরজুড়েই এ খাদ্যপণ্যটির চাহিদা থাকে। ফলে সেমাইয়ের বাজারও বিস্তার লাভ করছে।
প্যাকেটজাত সেমাই স্বাস্থ্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব সেমাই আধুনিক কারখানায় উৎপাদিত এবং মানসম্মতভাবে বাজারজাত করা। মানুষ এখন স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশি যত্নশীল, সেটাও সেমাইয়ের বাজার বড় হওয়ার কারণ।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে ঈদ মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমাই রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। আমেরিকা-ইউরোপসহ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সেমাই রপ্তানি করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে বনফুল, প্রাণ, ইস্পাহানি, স্কয়ারের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সেমাই বিদেশে রপ্তানি করেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেমাইয়ের বাজার মোটা দাগে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো হলো- সাধারণ বেকারির তৈরি, ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ড এবং প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত সেমাই। সাধারণ বেকারির মধ্যে আবার অধিকাংশ শুধু ঈদকেন্দ্রিক। অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রিয় ব্র্যান্ডও রয়েছে। যেমন- উত্তরবঙ্গে আকবরিয়া একটি জনপ্রিয় সেমাইয়ের ব্র্যান্ড। তবে সবকিছুর মধ্যে বড় কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। বনফুল, প্রাণ, কুলসুন, এসিআই, বিডিফুড, বসুন্ধরা, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, কিষোয়ান ও ওয়েল ফুড দেশে তৈরি সেমাইয়ের বড় ব্র্যান্ড।

দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো সেমাই তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার পর ছোট বেকারিগুলো এ পণ্যটির উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। একসময় স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই জনপ্রিয়তা পেলেও এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না মাঝারি বা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।
একসময় সেমাই উৎপাদনে জনপ্রিয়তা পাওয়া বগুড়ার এমন অনেক কারখানা এখন বন্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কিট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বায়েজিদ শেখ জাগো নিউজকে বলেন, এখন এ এলাকায় দেড়শো কারখানা রয়েছে। যেখানে আগে আরও কয়েকশো কারখানা সেমাই বানাতো। এর বাইরে আরও কিছু ব্যবসায়ী শুধু ঈদে সেমাই তৈরি করতেন। সেগুলো এখন নেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যেতো। তাদের মধ্যে করাচি সেমাই, বিউটি সেমাই, গোল্ডেন সেমাই, খুঁজলে এমন আরও অনেক নামই পাওয়া যাবে। কিন্তু ব্র্যান্ডের হাতে বাজার চলে যাওয়ায় আঞ্চলিক ছোট কারখানাগুলো এখন সেমাই তৈরিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনকি এ ধরনের অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে।

ঈদ ঘিরে বাজারে দুই ধরনের সেমাই বেশি পাওয়া যায়। একটি লাচ্ছা সেমাই, অন্যটি চিকন সেমাই। লাচ্ছা সেমাই আবার তৈরি হচ্ছে ডালডা অথবা ঘিয়ে ভেজে। তবে দেশের মানুষের কাছে দুই ধরনের সেমাইয়েরই সমান কদর।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের সেমাই ব্যবসায়ী নন্দী স্টোরের কার্তিক নন্দী জাগো নিউজকে বলেন, দুই ধরনের সেমাইয়েরই চাহিদা বেশি। বিশেষ করে শহুরে মানুষ ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই বেশি পছন্দ করে। গ্রামে সাদা সেমাই বেশি চলে।
এবার ঈদের বাজারে সেমাইয়ের বেচাকেনা কেমন, জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী বলেন, রমজানের শুরু থেকে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সেমাই কিনে নেন। গত দুই বছর করোনা সংক্রমণের কারণে বেচাবিক্রি ভালো ছিল না। তবে এবার সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। বেচাকেনাও ভালো।
ব্র্যান্ডগুলোর প্যাকেটজাত সেমাই আবার বিক্রয়কর্মীদের মাধ্যমে দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে কোম্পানিগুলো। ফলে এখন পাইকারি বাজারেও সেমাইকেন্দ্রিক ক্রেতাদের আনাগোনা আগের তুলনায় অনেক কমেছে বলে জানান পুরান ঢাকার এ সেমাই ব্যবসায়ী।
ঈদে ভোক্তা পর্যায়ে বনফুল গ্রুপের লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বরাবরই তুঙ্গে। বনফুল অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, রুচির পরিবর্তন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা- এ তিন কারণে এখন বাজারে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পণ্যটির রপ্তানিও বাড়ছে। ঈদেই নয়, সেমাইয়ের ভালো চাহিদা এখন বছরজুড়েই।
এনএইচ/এমকেআর/এসএইচএস/এমএস