প্রত্যাহার হচ্ছে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক, আসছে নতুন পর্ষদ
অবশেষে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রত্যাহার হচ্ছে প্রশাসক। সেইসঙ্গে কয়েকটি শর্তে কোম্পানিটি পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে নতুন পরিচালনা পর্ষদ। আগামী ৪ আগস্ট নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সমাঝোতার মধ্যদিয়ে প্রশাসক প্রত্যাহার ও নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
ওই বৈঠকে আইডিআরএ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও ডেল্টা লাইফের সাসপেন্ডেড পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও নতুন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনসহ কোম্পানি পরিচালনায় ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেল্টা লাইফের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে হাফিজ আহমেদ মজুমদার এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ড. মো. জুনায়েদ শফিক দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন।
এছাড়া পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেতে পারেন ডেল্টা লাইফের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান, ডেল্টা লাইফের সাসপেন্ডেড পরিচালনা পর্ষদে থাকা সুরাইয়া রহমান ও জেয়াদ রহমান। এদের পাশাপাশি সাকিব আজিজ চৌধুরী, চাকলাদার রেজানুল আলম এবং সাকিব আজাদ কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের হতে পারেন।
সূত্র জানিয়েছে, আইডিআরএতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন পরিচালনা পর্ষদ সব আইন পরিপালন করে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কোম্পানির আর্থিক বিবরণী সম্পর্কিত তথ্য উদঘাটনে নতুন করে অডিট ফার্মের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পাদন করবে।
চলমান মামলাগুলো চলতি বছরের ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ আগামী বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
এর আগে নিরীক্ষণ করা নিয়মাবলী শুনানি সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা হবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এক বছরে ব্যবসায়িক কৌশলপত্র দেওয়া এবং তার অগ্রগতি প্রতি এক মাসে অন্তর অন্তর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।
অতিদ্রুত বিমা আইন ও অন্যান্য আরোপিত বিধি-নিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে একজন দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য মুখ্য নিবাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে কর্তৃপক্ষের মামলাগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে সহায়তা করা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতি মাসে কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আগে যদি কোনো অনিয়ম চিহ্নিত হয়ে থাকে তার কোনো পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া, কর্তৃপক্ষের আগের জরিমানা আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা, পরিচালনা পর্ষদে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পর্যবেক্ষক হিসেবে মন্ত্রণালয়ের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিম্নে নয়) অন্তর্ভুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বৈঠকে।
অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সেইসঙ্গে আইডিআরএ'র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে গত দেড় বছরে ৩ দফায় প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে আছেন আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য কুদ্দুস খান।
অবশ্য প্রশাসক নিয়োগের আগেই আইডিআরএ'র সাবেক চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার অভিযোগ তোলে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছে।
দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান। ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ।
ডেল্টা লাইফে প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা পরবর্তীতে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়ান। ডেল্টা লাইফে প্রশাসক থাকা অবস্থায় কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে মাস্ক কেনার অভিযোগে তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে।
আর ডেল্টা লাইফের নিয়ে জড়ানো বিতর্কের জেরে আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে হয়েছে এম মোশাররফ হোসেনকে। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল আইডিআরএ সদস্য (লাইফ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোশাররফকে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৩ বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে হিসাবে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই চলতি বছরের ১৫ জুন তিনি পদত্যাগ করেন।
আইডিআরএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। চেয়ারম্যানের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়েই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য ব্যক্তিকে একটি বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিএই) হিসেবে নিয়োগ দেন মোশাররফ হোসেন।
এদিকে ডেল্টা লাইফে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে আদলতে মামলা চলমান রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এম মোশাররফের বিরুদ্ধে ৪০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বলে আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে।
দুদকেও এ রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ জুন দুদক থেকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়।
এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে শেয়ার ব্যবসা করার অভিযোগও রয়েছে। একদিকে তিনি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) কোটা সুবিধা নিয়ে শেয়ার কিনেন, অন্যদিকে তিনি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হয়েও বিভিন্ন বিমা কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন। এমন কিছু কোম্পানির শেয়ারে তার বিনিয়োগ ছিল, যেগুলোর দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ে।
এমএএস/এমএএইচ/