বাড়তি খরচে চিড়েচ্যাপটা মানুষ, ক্রেতাশূন্য শপিংমল
একে তো করোনা মহামারির ধাক্কা, তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সবমিলিয়ে মন্দার মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে, হু হু করে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের বোঝা টানতে চিড়েচ্যাপটা সাধারণ মানুষ। ব্যয়ের লাগাম টানতে খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। ফলে কয়েক মাস ধরেই পোশাক, জুতা, অলঙ্কারসহ বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি কমে গেছে।
এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছে লোডশেডিং। সারাদেশে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি দামে গ্যাস কিনতেও রাজি ব্যবসায়ীরা। তবে বৈশ্বিক সংকটের কথা মাথায় রেখে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার এমন মন্তব্যে জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেককেই বলতে শোনা যায়, সরকার হয়তো দিনের বেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে চায়! তবে এরপরই এ বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কয়েক মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
তবে সরকার যতই আশ্বস্ত করুক না কেন, মানুষের মধ্যে অজানা আতঙ্ক রয়েই গেছে। অধিকাংশ মানুষই এখন হিসাব করে খরচ করছেন, অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যান্য কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে কয়েক মাস ধরেই দেশের শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে ক্রেতা সংকট আরও বেড়েছে। অধিকাংশ সময় ক্রেতাশূন্য থাকছে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান। ক্রেতা না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য বিক্রি কমে আসায় একদিকে ব্যবসায়ীদের আর্থিক চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে দেখা দিচ্ছে হতাশা।
রাজধানীর ছোট-বড় বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, পোশাকের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের খুব একটা আনাগোনা নেই। জুতা, জুয়েলারি, আসবাবপত্রের দোকানগুলোতেও একই অবস্থা।
জাগো নিউজকে ব্যবসায়ীরা জানান, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কয়েক মাস ধরেই ব্যবসায় মন্দা চলছে। কিছুদিন আগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব দুর্গাপূজা গেছে। দুর্গাপূজার সময়েও খুব একটা বিক্রি হয়নি। পূজার পর ক্রেতা সংকট আরও বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বিগত বেশ কিছুদিন ধরে যে হারে লোডশেডিং হচ্ছে তাতে এমনিতেই মানুষের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার বক্তব্য মানুষের শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ মানুষ এখন আর বাড়তি খরচ করতে চাইছেন না। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায় মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের পোশাক বিক্রেতা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে কয়েক মাস ধরেই আমাদের বিক্রি ভালো হচ্ছে না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে যে ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ফলে আমাদের ব্যবসার পরিস্থিতি আরও খরাপ হয়েছে।
তিনি বলেন, দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখেন কোনো ক্রেতা নেই। শুধু আমাদের দোকান নয়, এখানকার প্রায় সব দোকানের একই অবস্থা। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন ক্রেতাশূন্য থাকছে। ক্রেতার জন্য আমাদের তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এভাবে চললে দোকান ভাড়ার টাকা ওঠানোই কষ্টকর হয়ে যাবে।
মৌচাক মার্কেটের ব্যবসায়ী ফিরোজ বলেন, আমরা খুব কষ্টে আছি। ক্রেতা নেই, বিক্রি নেই। সংসর চালাতে প্রতি মাসেই সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। এভাবে চললে ব্যবসা করা কঠিন। প্রতিদিন দোকান খুলে বসে থাকি, আশানুরূপ ক্রেতা পাই না। দিন যত যাচ্ছে চিন্তায় চিন্তায় মনে হচ্ছে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি।
বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন ইনফিনিটি’র তালতলা শোরুমের এক বিক্রয় প্রতিনিধি। তিনি বলেন, বিক্রির অবস্থা খুব খারাপ। জিনিসপত্রের বাড়তি মূল্যের মধ্যে অতিরিক্ত লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর বিক্রি আরও কমে গেছে। বিক্রি কমে এমন জায়গায় এসেছে যে চাকরি নিয়ে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তায় থাকি। এভাবে চললে মালিক তো আর আমাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবেন না।
রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরাও পণ্যের বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি করা ইকরামুল ইসলাম বলেন, এখন কোনো ব্যবসায়ী ভালো নেই। সবার বিক্রিতে ভাটা। দিনের বেশিরভাগ সময় ক্রেতা থাকে না। শুধু রিকশাচালক, দিনমজুররা নয়- আমাদের মতো ব্যবসায়ীরাও এখন কষ্টে আছে। মানুষের হাতে এখন টাকা-পয়সা খুব কম।
নিউমার্কেট এলাকায় জুতা বিক্রি করেন খায়রুল। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমাদের দোকানে প্রতিদিনই কিছু না কিছু ক্রেতা থাকে। কিন্তু এখন বেচাবিক্রি খুবই কম। পাঁচ-ছয় মাস আগে যে বিক্রি ছিল এখন তার অর্ধেকও নেই। আমি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছি। এত খারাপ অবস্থা আগে কখনো হয়নি।
একই অবস্থা রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতেও। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে কিছু ক্রেতার আনাগোনা দেখা গেলেও তাতে সন্তুষ্ট নন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটটিতে নারীদের পোশাক বিক্রি করা হৃদয় বলেন, আমাদের বিক্রি চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। তিন ভাগ ক্রেতা এখন নাই হয়ে গেছে। দিনের বেশিরভাগ সময় দোকানে ক্রেতা থাকে না।
বিক্রি কেন কমে গেছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন জিনিসপত্রের যে দাম তাতে সবাই কষ্টে আছে। এর মধ্যে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় উৎপাদনও কমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে।
গত ২৩ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমাদের সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কী হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।’
প্রধামন্ত্রীর উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরদিন (২৪ অক্টোবর) তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
এর একদিন পরই (২৫ অক্টোবর) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমি মনে করি এত শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা চেষ্টায় আছি, ভালো অবস্থায় যাবো। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে কত দ্রুত লোডশেডিং থেকে বেরিয়ে আসতে পারি সে রকম ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবো।
বুধবার (২৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় নসরুল হামিদ বলেন, শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক এই সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধান করা আবশ্যক। ব্যবসায়ীদের সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামীতে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্পের প্রসারে কাজ করা হবে।
তিনি বলেন, গাজীপুর-আশুলিয়া-নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাপ কম হওয়ার সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে। ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ১৭ শতাংশ ও শিল্পে ১৮ শতাংশ গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। দেশীয় ও আমদানি মিলিয়ে এখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে খরচ পড়ছে ২৮ টাকা ৪২ পয়সা। আর প্রতি ইউনিট বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সায়। শিল্পের প্রসারের জন্যই কম মূল্যে গ্যাস বিক্রি করা হয়। ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান উদ্বেগ দ্রুত লাঘব করা হবে।
এ সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, কোভিড পরিস্থিতি আমাদের পরিকল্পনা মতো এগোতে দেয়নি। শিল্প-কারখানায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
এসময় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান সমস্যা বৈশ্বিক। গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে হলেও আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ চাই। কর কাঠামো পুনর্গঠন করলে মূল্য সমন্বয় সহনীয় থাকবে।
এমএএস/কেএসআর/জেআইএম