খাদ্য সংকটের আশঙ্কা

আমদানি কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪৭ পিএম, ০৯ নভেম্বর ২০২২
প্রতীকী/ছবি: মাহবুব আলম

কারোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। অস্থির বিশ্ব অর্থনীতি। যার আঁচ বাংলাদেশেও। ডলারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বাড়লো জ্বালানি তেলের দাম। যার প্রভাব সব উৎপাদন এবং নিত্যপণ্যে। এর মধ্যেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। আলোচনায় উঠে আসছে খাদ্য ঘাটতি প্রসঙ্গ। বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা দেশের তালিকায়ও আছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে চালসহ অন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যেতে পারে।

বিগত কয়েক মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) ছাড়া আরও কিছু খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে অনেক দেশ। বৈশ্বিক এ মন্দার কবলে পড়লে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। এসব সংস্থার খাদ্য সংকটের তালিকায় নাম আছে বাংলাদেশেরও।

আরও পড়ুন:>>> ‘সমস্যা থেকে শিক্ষা নিলেই দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পাবো’ 

এদিকে আসন্ন এ সংকটের প্রস্তুতি হিসেবে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যে একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি সেটা প্রধানমন্ত্রীও বারবার বলেছেন। আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা কিন্তু অমূলক নয়। সেটা কোন দেশে কতটুকু হবে বা হবে না- সেটা নির্ভর করে সেই দেশের জনসাধারণ ও সরকার কীভাবে তা মোকাবিলা করবে তার ওপর। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। এর মধ্যে আমরা যদি চালের উৎপাদন ধরে রাখতে পারি, তাহলে কিছুটা সামাল দিতে পারবো।’

এ অর্থনীতিবিদের মতে, ‘আমরা খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলি সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। বলা যেতে পারে, চালে মোটামুটি আমাদের চলে যায়। কিন্তু অন্য কোনো খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। অন্য কোনো দানাদার খাদ্যেও নয়। বলা যায়, আমদানিনির্ভর খাদ্যের ভরসায় রয়ে গেছি আমরা।’

আরও পড়ুন>> পাইকারিতে চালের দাম সহনীয়, খুচরায় বাড়ছেই 

এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এখন যেসব খাদ্য আমরা বেশি বেশি আমদানি করছি সেটাও কমাতে হবে। কারণ বিশ্বমন্দা শুরু হলে সেগুলোর দাম আরও বেড়ে যাবে। চিনি, তেল, আটা-ময়দার মতো পণ্যগুলোর জন্য আরও বড় অংকের আমদানি ব্যয় হবে। সেটি সুখকর নয়।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমাদের দেশে খাদ্য ঘাটতির চাপ অন্য দেশের তুলনায় বেশি হবে। কারণ জনসংখ্যা বেশি। ফলে যথেষ্ট উৎপাদন বাড়াতে না পারলে খাদ্য আমদানিতে আমাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে আরও বড় চাপ তৈরি করবে।

jagonews24

এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর আমরা যে সবুজ বিপ্লব শুরু করেছিলাম, এর সুফল পেয়েছি। উচ্চফলনশীল জাতের জন্য সার্বিক খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার, পেস্টিসাইড, ইরিগেশনসহ বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য আমরা দানাদার শস্যে সাফল্য পেয়েছি। আমাদের সবজি, মাছ ও ফল উৎপাদনে সফলতা রয়েছে। সেই পথে টেকসইভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন>> দেশে চালের অভাব নেই: খাদ্যমন্ত্রী

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘আমরা যদি সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি তাহলে সংকট ভয়াবহ হবে না। সেজন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, আমদানি কমাতে হবে। আমাদের আমন বেশ ভালো হয়েছে। আসন্ন বোরো মৌসুমের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বোরো আবাদের মাধ্যমে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অর্ধেক নিশ্চিত হয়। কিন্তু এজন্য সবচেয়ে বেশি উপকরণ লাগে, যা প্রায় ৮০ শতাংশ। আমাদের তেল, সার ও বীজের দামের সমস্যা রয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি তাতে কৃষক উৎপাদনে যেতে পারবে না।’

জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘সেজন্য সরকারকে এসবের দাম কমাতে হবে। ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা বাড়াতে হবে। তাদের সাশ্রয়ীমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।’

আরও পড়ুন>> কৃষকের প্রণোদনা বাড়ানোর পরিকল্পনা, নেই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ 

এদিকে শুধু চালের উৎপাদনে সাফল্য নয়, সার্বিক খাদ্য সংকট কাটাতে প্রয়োজন গম, ডাল, তেলের মতো জরুরি খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে বড় সাফল্য। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে কৃষিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সেগুলো হলো- খাদ্যের নিরাপত্তা, টেকসই ও দায়িত্বশীল কৃষি। আমাদের সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়েই অনেক বেশি উৎপাদন করতে হবে। বিশেষ করে এখন রিজার্ভ সংকট। সে কারণে যেসব খাদ্য আমদানি করতে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা যাচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে।’

আগামী বছর অন্তত বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই বলে দাবি করেছেন খাদ্য সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং সাধন চন্দ্র মজুমদার। তারা বিভিন্ন সভায় দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপগুলো সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরছেন। কৃষিমন্ত্রীর দাবি, চলতি আমন ধান নিয়ে উৎকণ্ঠা কেটে গেছে, বোরো নিয়েও কোনো শঙ্কা নেই। সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে।

অন্যদিকে খাদ্য ঘাটতির কোনো শঙ্কা নেই দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলছেন, অহেতুক আতঙ্ক না ছড়ালে কোনো সমস্যা নেই। মহামারির পর যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। তবে সে পরিস্থিতি বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে না।

এসব বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব ড. আনোয়ার ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধান খাদ্যগুলো নিয়ে সংকটের তেমন কারণ নেই। চাল আমরা নিজেরাই করি। যেটা আমদানি হয় সেটা সরকারের ব্যর্থতা। ঠিকমতো কিনতে পারি না বলেই আমদানি করি। কৃষককে দাম দিতে পারছি না বলেই তারা সরকারকে ধান দেয় না।’

‘এখন সংকট যেটা হচ্ছে, যদি সরকার ধান উৎপাদনের জন্য সার, বিদ্যুৎ সাপ্লাই দিতে না পারে তখন সমস্যা বাঁধবে। বোরোর ৭০ শতাংশ ডিজেলনির্ভর সেচ। সেটা অনেক চড়া দাম। সারেও সংকট রয়েছে, সেটা সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে সরকার।’

আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘আমাদের সবজি, মাছ, দুধ, ডিমে সংকট হবে না। সেগুলো দিয়ে চলবে। কিন্তু অনেক পণ্য ও কৃষি উপকরণ আমদানি হয়। সেগুলো যেন ব্যাহত না হয়। যেমন তেল, চিনি লাগবে। উৎপাদনের জন্য আবার সার ও ডিজেল আমদানি করতে হবে। সেগুলো যেন ঠিক থাকে। না হলে সংকট চরম হবে।’

তিনি আরও বলেন, এছাড়া এগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃষির বেসিক আইটেমের ওপর ট্যাক্স-ভ্যাট উঠিয়ে রাখা দরকার। আবার যারা ডলার সংকটে রয়েছে, তাদের সাধ্যমতো সাপোর্ট দেওয়া। যেন তারা সুবিধামতো সময়ে আনতে পারে। তাহলে বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।

এনএইচ/এএসএ/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।