১৩ বছর বয়সে ‘মিনা পাল’ থেকে যেভাবে ‘কবরী’ হয়েছিলেন
ঢাকাই সিনেমার অন্যতম সফল নায়িকার নাম সারাহ বেগম কবরী। কিশোরীবেলায় অর্থাৎ, মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিনেমার রঙিন জগতে এসে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন। সেই রঙের ছটা তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অমলিন ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’র খেতাবটিও লাভ করেছিলেন। আজ (১৯ জুলাই) এ অভিনেত্রীর জন্মদিন।
কবরী ‘সুতরাং’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সুজন সখী’র মতো সিনেমায় তার অনবদ্য অভিনয় সিনেমাপ্রেমীরা মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করেছেন। দর্শকরা খুব অল্প সময়ে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন কবরীকে অসামান্য অভিনেত্রী হয়ে উঠতে। সিনেমায় প্রায় সবগুলো শাখায় তিনি তার পারদর্শীতার ছাপ রেখে গেছেন। অভিনয়ে, প্রযোজনায়, নির্মাণে তার সাত দশকের জীবনটা সত্যিকারার্থে বিস্ময় জাগানিয়া সফলতার উপাখ্যান।
‘দেবদাস’ ছবিতে কবরী ও বুলবুল আহমেদ
জেনে নেওয়া যাক কবরীর অভিনেত্রী হয়ে ওঠার সূচনা লগ্নের কথা। নির্মাতা সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ সিনেমার ‘জরিনা’ চরিত্রের জন্য একটি মেয়ের সন্ধান করছিলেন। ঠিক সেই সময়ে কবরীর সন্ধান দিলেন সিনেমাটির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা। তবে বেঁকে বসলেন কবরী মা। তিনি মেয়েকে সিনেমার কাজে যেতে সম্মতি দিচ্ছেন না। জীবদ্দশায় কবরী তার অভিনেত্রীর হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মা কান্নাকাটি করে বাবাকে বললেন, “আমার দুধের শিশুকে আমি দেব না।” আমারও মা-ভাই-বোনদের ছেড়ে ঢাকায় আসতে ভালো লাগছিল না। মায়ের কান্না দেখে আমিও কাঁদতে শুরু করলাম। বাবা বুঝিয়ে বললেন, “ওরা ডেকেছে। আগে মিনা যাক। যদি ভালো না লাগে, তাহলে চলে আসবে।” এই বলে বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হলেন।’ সেই সময়ে কবরী ১৩ বছরের কিশোরী।
কবরী সিনেমার জন্য প্রথমবার ঢাকায় এসে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বাবার সঙ্গে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। থাকার জন্য পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে উঠেছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি প্রথম টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজারও অভিজ্ঞা অর্জন করেন। এসব কথা তিনি তার লেখা স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’ বইতে লিখেছেন।
কবরী
সিনেমায় কবীর অভিনয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর শুরু হলো নাম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা। নির্মাতা সুভাষ দত্ত লেখক সৈয়দ শামসুল হককে অনুরোধ করেছেন একটা নাম ঠিক করে দিতে। এসময় দেখা গেল যে, নামেরই প্রস্তাব আসে, সেই নামে কেউ না কেউ রয়েছেন। এভাবে একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ‘করবী’ নামটি রাখার ব্যাপারে। এতে কেউ একজন বললেন ‘কবরী’ হলে ভালো হয়। অবশেষে দুটি নাম নিয়ে ভোটাভোটির আয়োজন করা হয়। এতে ‘কবরী’ নামটিই চূড়ান্ত করা যায়। এভাবে ‘মিনা পাল’ থেকে তিনি হয়ে ‘কবরী’ হয়ে যান।
কবরী অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘সুতরাং’ ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এটির মাধ্যমেই তিনি ‘মিষ্টি মেয়ে’ হয়ে ওঠেন। কবরীর ক্যারিয়ারে নারী ‘সারেং বৌ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। এটি চরিত্রপ্রধান চলচ্চিত্র ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি এদেশের গ্রামীণ নারীর সংগ্রাম উঠে এসেছে। কবরী সার্থকভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন। চরিত্রটি করেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে এটিই তার একমাত্র জাতীয় পুরস্কার। সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। নায়ক ফারুক এতে কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন।
‘সুতারাং’ ছবিতে কবরী ও সুভাষ দত্ত
কবরী অভিনীত অনেক কালজয়ী সিনেমার মধ্যে, ‘দেবদাস’ ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বিনিময়’, ‘রংবাজ’, ‘বধূ বিদায়’, ‘আগন্তুক’, ‘বাহানা’ ও উল্লেখযোগ্য।
কবরী
কবরী ২০০৬ সালে ‘আয়না’ নামের সিনেমা দিয়ে নির্মাণে নাম লেখান। তবে সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সফল হয়নি। এতে ফেরদৌসের বিপরীতে অভিনেত্রী সোহানা সাবা অভিনয় করেন। এরপর প্রায় ১৫ বছর বিরতি নিয়ে ২০২০ সালে আবার সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন কবরী। সিনেমাটির নাম ‘এই তুমি সেই তুমি’। এটির কাজ প্রায় শেষের পথে থাকলেও সিনেমাটির সমাপ্তি দেখে যেতে পারেননি তিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ৭১ বছর বয়সে কবরী অনন্তের পথে যাত্রা করেন।
এমএমএফ/এএসএম