প্রাণীকুল বাঁচলেই বাঁচবে পৃথিবী

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
প্রাণের বৈচিত্র্য আছে বলেই আমাদের জীবন এত সুন্দর

ফাহিম হাসনাত
আজ ৪ অক্টোবর, শততম বিশ্ব প্রাণী দিবস। কিন্তু এই দিবসটি উদযাপনের চেয়ে জরুরি হলো পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের ওপর নেমে আসা ঘোর বিপদ নিয়ে আলোচনা করা। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে জলজ জেলিফিশ আবিষ্কার করেছিলেন।

সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজকের আধুনিক পৃথিবী, কোটি কোটি বছরের প্রাণের বৈচিত্র্য মানুষের নানামুখী প্রয়োজন মেটানোর পথে আজ বিলীন হতে চলেছে। কেবল বাঘ, হাতি বা হরিণের মতো কয়েকটি আলোচিত প্রজাতিকে রক্ষা করলেই এই বিশাল প্রাণের বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়।

জাতিসংঘের তথ্য বলছে, প্রায় সাতশো বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণীর বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল। চেনাজানা প্রায় ২০ লাখ প্রাণ ও উদ্ভিদের মধ্যে ৭ থেকে ১৩ শতাংশই এরই মধ্যে চিরতরে হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ১৯৬৮ সাল থেকে নিয়মিত ‘লাল তালিকা’ প্রকাশ করছে। তাদের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৪০ হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এর মধ্যে উভচর ৪১ শতাংশ, স্তন্যপায়ী ২৬ শতাংশ এবং পাখি ২৩ শতাংশ।

এই প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাসের প্রধান কারণগুলো স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দাবানল, খরা, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট এবং সবচেয়ে মারাত্মক হলো প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস। এছাড়াও দুর্বল আইন, চোরা শিকারি, হাওর-জলাভূমি ও নদীর নাব্য হ্রাস, জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার এবং বন্য প্রাণী নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য এই নীরব বিলুপ্তি প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এই বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কেবল প্রকৃতির জন্য নয়, আমাদের নিজেদের জীবন, উন্নয়ন এবং শান্তির জন্যও অত্যাবশ্যক।

জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আইইউসিএন-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এ দেশে ১৯৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৬৩০ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৬৯ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ এবং ৫ হাজার প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ (১৬০ প্রজাতির শৈবাল সহ) রয়েছে।

এই অফুরন্ত ভান্ডার ধারণ করে আছে আমাদের বন, যা প্রাণীর জন্ম, বিচরণ ও প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান। একসময় গারো পাহাড়সহ দেশের বনাঞ্চলে বাঘ, চিতাবাঘ, উল্লুক, নীলগাই, বন্যহাতি, হরিণ, রামকুত্তা, গন্ধগোকুল, বনরুইয়ের মতো বহু প্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল। এছাড়া বুনোহাঁস, সারস, ময়না, ঘুঘু, কোকিল, বক, কোয়েল, ঈগল, বাজপাখি, শকুন, হারগিলা এবং গভীর রাতে ডাহুকের মিষ্টি ডাক ছিল অতি সাধারণ দৃশ্য।

কিন্তু আজ এসব প্রাণীর বিচরণ আর সচরাচর চোখে পড়ে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া বর্তমানে বন্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক কারণে বনাঞ্চলে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত বৈধ-অবৈধ হস্তক্ষেপের ফলেই এই বিপর্যয়।

দেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে এরই মধ্যে ১১টি প্রজাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আরও ৪০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ এবং কালো ভল্লুকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী।

পাখিদের মধ্যে লাল শির হাঁস ও ময়ূর বিলুপ্ত হয়েছে। মহাবিপন্ন পাখির তালিকায় রয়েছে কালো তিতির, কাঠময়ূর, রাজধনেশ, লাল শির শকুন, হাড়গিলা, পাহাড়ি ময়না, মদনটাক প্রভৃতি। বাংলার বিখ্যাত বালিহাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিলা বা মদনটাক, রাজশকুন, সবুজ ময়ূর চিরতরে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। শিকারিদের কবলে পড়ে বিশাল আকারের সারস পাখিও বিলুপ্ত হয়েছে।

সরীসৃপ ও জলজ প্রাণীর ক্ষেত্রে মিঠা ও লবণাক্ত পানির কুমির বিলুপ্ত হয়েছে; তবে মেছোকুমির অতিবিপন্ন অবস্থায় টিকে আছে। হলুদ পাহাড়ি কাছিম এবং বড় কাইটা কাছিমও অতিবিপন্ন। এমনকি নির্বিষ গুলবাহার অজগর ও বিষধর চন্দ্রবোড়ার মতো সাপও অতিবিপন্ন তালিকায় স্থান পেয়েছে। একসময় রাজশাহী-দিনাজপুরে দেখা যাওয়া কৃষ্ণষাঁড়, সিলেট ও হাওর এলাকায় দেখা যাওয়া বারো শিঙা হরিণ (জলার হরিণ) এবং দেশের সব বনাঞ্চলে দেখা যাওয়া বনমহিষ আজ শুধু ইতিহাসের পাতায়।

আমরা যদি বাঘ, হাতি, হরিণের মতো কিছু প্রাণীর প্রতি যত্নের পাশাপাশি অন্য সব প্রাণীর কথাও সমানভাবে চিন্তা না করি, তবে এই নীরব বিলুপ্তি থামানো অসম্ভব। প্রাণের বৈচিত্র্য আছে বলেই আমাদের জীবন এত সুন্দর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই মানুষের নির্বিচার ব্যবহার বন্ধ করে প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল রক্ষায় আরও কঠোর আইন ও সচেতনতা জরুরি। অস্তিত্বের সংকটে থাকা এই প্রাণগুলোকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

আরও পড়ুন
প্রবীণরা বোঝা নন, জ্ঞানের ভান্ডার
৩৪ বছর হাতের নখ কাটেন না তিনি

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।