অভিশপ্ত থেকে আশীর্বাদ
ইউরোপে বিড়ালের অন্ধকার অধ্যায়, সমুদ্রে সৌভাগ্যের সঙ্গী
পোষা প্রাণীর মধ্যে বিড়াল সবচেয়ে আদুরে এবং প্রিয় সবার কাছে। মানুষ এবং বিড়ালের এই সুসম্পর্ক আজ থেকে নয়। বিড়াল মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে কোটি কোটি বছর ধরে। তবে মানুষ এবং বিড়ালের মধ্যে অনেক দীর্ঘ এবং কখনো কখনো জটিল সম্পর্ক রয়েছে। মিশরীয় আমলে বিড়ালের পূজা করা থেকে শুরু করে মধ্যযুগে তাদের ভয় করা পর্যন্ত, কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ এই ছোট প্রাণীদের সঙ্গে সংযুক্ত।
একসময় মানুষ ভাবত, বিড়াল হলো অশুভ। আজ আমরা ভাবি, বিড়াল হলো ভালোবাসার প্রতীক। এই বৈপরীত্যটাই বিড়ালের ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় দিক। একদিকে শয়তানের দূত, অন্যদিকে সমুদ্রযাত্রার তাবিজ! ইউরোপের মধ্যযুগ আর সমুদ্রের গল্পে মিলে যায় এক রহস্যময় অধ্যায়, যেখানে এক ছোট্ট প্রাণী মানুষকে একই সঙ্গে ভয়ও দেখিয়েছে, আবার বাঁচিয়েও দিয়েছে।
মধ্যযুগ ছিল ধর্মীয় কুসংস্কার ও ভয়াবহ ভুল বিশ্বাসের সময়। সেই সময় ইউরোপে মনে করা হতো, বিড়াল হলো জাদুকরীদের সহযোগী, এমনকি শয়তানের দূত। বিশেষ করে কালো বিড়াল ছিল ভয়ের প্রতীক। রাতের আঁধারে চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকা বিড়ালকে মানুষ ‘অলৌকিক’ মনে করত।

চতুর্দশ শতকে গির্জার প্রভাব ছিল চরমে। অনেক ধর্মযাজক বিশ্বাস করতেন, বিড়ালের মধ্যে মন্দ আত্মা বাস করে। ফলে তাদের হত্যা করা ‘পবিত্র কাজ’ বলে ধরা হতো। হাজার হাজার বিড়ালকে তখন গির্জা, গ্রাম ও শহরের রাস্তায় পুড়িয়ে মারা হতো শুধু সন্দেহের বশে।
এই ভয়ানক কুসংস্কারের ফল হয়েছিল ভয়াবহ। বিড়াল কমে যেতেই বেড়ে গেল ইঁদুরের সংখ্যা। আর সেই ইঁদুরই ছিল ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ রোগের মূল বাহক। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায় এই মহামারিতে।
অর্থাৎ যে বিড়ালকে ‘অভিশাপের প্রাণী‘ মনে করা হয়েছিল, তারাই আসলে মানুষকে মহামারির হাত থেকে রক্ষা করতে পারত। ইতিহাসের এক ভয়াবহ ব্যঙ্গ!
এছাড়া আরও একটি কল্পকাহিনি প্রচলিত ছিল ইউরোপে। ইউরোপীয়রা সেসময় মনে করতেন রাতের বেলায় জাদুকরীরা বিড়ালে রূপ নেয়। ফলে কোনো বিড়াল যদি হঠাৎ রাতে কারো সামনে এসে পড়ে, মানুষ তাকে ভয় পেত ভাবত, কোনো দুষ্ট আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কুসংস্কার এতটাই গভীরে গিয়েছিল যে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে অনেক গ্রামেই বিড়াল দেখা মানে দুর্ভাগ্য আসছে বলে ধরা হতো।
এমনকি ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম পর্যন্ত বিড়াল পছন্দ করতেন না। তার আমলে কালো বিড়াল দেখা মানে রাজকীয় অপয়া বলে মনে করা হতো। তবে মজার ব্যাপার হলো এই ভয়ের মাঝেই কিছু রাজপরিবার বিড়ালকে রাখত রাজকীয় প্রহরী হিসেবে, কারণ তারা ইঁদুর ধরে খাদ্য মজুদ বাঁচাত। এই দ্বৈত ধারণাই বিড়ালের প্রতি ইউরোপীয় সমাজের বিভ্রান্ত মনোভাবকে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝায়।

কিন্তু যখন ইউরোপের স্থলে বিড়ালের ভাগ্য অন্ধকার, তখন সমুদ্রপাড়ে তারা নতুন জীবনের আশ্রয় পায়। মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপীয় নাবিকেরা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শুরু করে। তখন নতুন ভূমি আবিষ্কারের যুগ। জাহাজের খাদ্য, কাপড়, এমনকি কাঠও নষ্ট করে দিত ইঁদুর। সমাধান হিসেবে বিড়ালকে জাহাজে রাখা শুরু হয়।
শুরুতে বিড়ালকে রাখা হতো শুধু ইঁদুর ধরার জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে নাবিকেরা বুঝে ফেলল যখন জাহাজে বিড়াল থাকে, তখন সমুদ্রযাত্রা মসৃণ হয়, ঝড় কম আসে, যাত্রা নিরাপদ হয়। এরপর থেকেই বিড়াল হয়ে উঠল সৌভাগ্যের প্রতীক।
ইউরোপীয় নাবিকেরা বিশ্বাস করত, যদি কোনো বিড়াল ডেকের উপর শান্তভাবে বসে থাকে, তবে আবহাওয়া ভালো থাকবে।
কিন্তু যদি বিড়াল অস্থির হয়ে ওঠে বা জাহাজের পাশে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস শব্দ করে, তবে সেটা ঝড়ের পূর্বাভাস। অনেকে বিড়ালের আচরণ দেখে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করত!

ইংল্যান্ডের জাহাজগুলোতে বিড়ালকে বলা হতো ‘শিপস ক্যাট’। এই বিড়ালরা শুধু পোষা প্রাণী ছিল না, ছিল ক্রু সদস্য। অনেক ক্যাপ্টেন তাদের বিড়ালের জন্য বিশেষ ঘুমানোর জায়গা, খাবার আর এমনকি ছোট ইউনিফর্ম পর্যন্ত তৈরি করাতেন।সবচেয়ে বিখ্যাত জাহাজের বিড়াল হলো উনসিনকাবেল স্যাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ছিল এই বিড়ালটি। জাহাজ ডুবে গেলেও তিনবার বেঁচে যায় এই বিড়ালটি এবং প্রতিবারই অন্য জাহাজ তাকে উদ্ধার করে! তারপর থেকে স্যাম হয়ে ওঠে ‘অদম্য ভাগ্যের প্রতীক’।
সমুদ্র থেকে স্থলে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে বিড়াল। একসময় নাবিকদের এই বিশ্বাস ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, বিড়াল ঘরে থাকলে সৌভাগ্য আসে, খারাপ আত্মা দূরে থাকে। এভাবেই যে প্রাণী একসময় ‘শয়তানের দূত’ বলে ঘৃণিত ছিল, সেই পরিণত হলো ‘ভাগ্যের প্রতীক’।
ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও নরওয়ের উপকূলীয় গ্রামগুলোতে আজও অনেক পরিবার কালো বিড়ালকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে।
তারা বলেন, বিড়াল যদি বারান্দায় মুখ ধোয়, বুঝতে হবে কেউ শুভ সংবাদ নিয়ে আসছে! সময়ের সঙ্গে মানুষ বুঝেছে বিড়াল কোনো অভিশাপ নয়, বরং প্রকৃতির এক নিখুঁত ভারসাম্যের প্রতীক। তাদের নীরব পদক্ষেপ, একাগ্রতা, আর স্বাধীন স্বভাব সব মিলিয়ে বিড়াল হয়ে উঠেছে মানব সভ্যতার এক দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গী।
আজ যখন ইউরোপের গৃহে বিড়াল রাজকীয় আরামে ঘুমায়, তখন ইতিহাসের পাতায় এখনও রয়ে গেছে তাদের অন্ধকার অতীতের ছায়া। যে সমাজ একসময় তাদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিল, সেই সমাজই আজ তাদের জন্য বিশেষ দিবস পালন করে, শেল্টার তৈরি করে, আইন প্রণয়ন করে।
আরও পড়ুন
ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ যেখানে, নাক হারাতে বসেছিলেন রুহি চেনেট
আজকের কন্যাশিশু ভবিষ্যতের নোবেল বিজয়ী
সূত্র: ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি এনসাইক্লোপিডিয়া
কেএসকে/জেআইএম