জেনারেলদের দৃষ্টিতে ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৩

আশরাফুল ইসলাম, লেখক ও শিক্ষক

পাকিস্তানের ভাগ্য সূতোর উপর ঝুলে ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ কালো রাত্রে পৃথিবীর ইতিহাসের যে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল সেদিনই সূতোটা ছিঁড়ে যায় বাঙালি গঠন করে স্বাধীন বাংলাদেশ।

আর সে কারণেই হয়তো ভারতীয় মাষ্টার স্ট্রাটেজিস্ট সুব্রানিয়াম মন্তব্য করেছিলেন ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তান ভাঙার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সুযোগ বলে।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী ‘কল-রেডী’

মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোন জাতির স্বাধীন হওয়ার যত সংগ্রামের ইতিহাস আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে তার মধ্যে সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল পাঠ। নদীর স্রোত যেমন একটা সময় সাগরে গিয়ে মিশে যায় ঠিক তেমনি বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়েছে ২৫ মার্চের নৃশংসতম রাত্রে।

১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, বই লেখা হয়েছে এখনো হচ্ছে আর ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা নিয়ে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পৃথিবীর নানান গবেষক ও লেখক বই লিখেছেন পাকিস্তানি পরাজিত জেনারেলরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

যদি পাকিস্তানি লেখকদের বেশীরভাগই মিথ্যাকথার ফুলঝুরি দিয়ে তাদের বইগুলো সাজিয়েছেন, তবে তারপরও কিছু সত্য ঘটনা যেগুলো তারা নিজেরাও অস্বীকার করতে পারেননি। তাদেরই একজন পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল এ এ খান নিয়াজী। তিনি ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিলেন।

এই কুখ্যাত জেনারেলের হাত বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এই নিয়াজী বাঙালি নারীদের ধর্ষণের মদদ দিয়েছিলেন ও মন্তব্য করেছিলেন বাঙালির জাত আমি বদলে দিবো। সেই নিয়াজীর নিজের রচিত বইয়ের নাম ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’। এই বইয়ে নিয়াজী ২৫ মার্চ কালো রাত্রের হত্যাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-

আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো

২৫-২৬ মার্চ রাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানলেন। শান্তিপূর্ণ রাতটি পরিণত হলো আর্তনাদ, হাহাকার প্রাণভয়ে চেচামেচি ও আগুনে জ্বালিয়ে পুরিয়ে দেওয়ার রাত। জেনারেল টিক্কা তার অধীনে থাকা সমস্ত সেনাশক্তি লেলিয়ে দিলেন যেন কোনো একটি শত্রুর উপর হামলা করা হয়েছে।

নিজের বিপথগামী ও ভুলপথে চলা লোকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। এই সামরিক হামলাটি ছিলো পুরোদস্তুর নিষ্ঠুরতার একটি নগ্ন প্রদর্শনী। চেঙ্গিস খান ও হালাকু খান বুখারা আর সমরখন্দে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল কিংবা জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার যে নৃশংসতা বা বর্বরতা দেখিয়েছিল এটা তার চেয়েও অনেক নির্মম ছিল।

সৈনিকদের প্রতি টিক্কার নির্দেশনা ছিল- আমি মাটি চাই, কোনো মানুষ নয়। নিয়াজির মতো একজন পাকিস্তানি জেনারেল যখন ২৫ মার্চের কালরাত্রের এই নৃশংস ঘটনা স্বীকার করেন, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না সেদিন বাঙালির কত রক্ত ঝরেছিল।

২৫ মার্চের কালোরাত্রির নৃশংস বর্ণনা এসেছে আরেকজন পাকিস্তানি জেনারেল সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে। এই জেনারেল ১৯৭১ সালের পুরো নয় মাস টিক্কা খান ও জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ অফিসার ছিলেন। তার বইয়ে ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডকে এভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি-

আরও পড়ুন: ২৩ বছর ধরে টয়লেট পেপার খাচ্ছেন এই নারী

আকাশে তারার মেলা। শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন বসন্তে ঢাকার রাত যে রকম চমৎকার হয় ঠিক তেমনই ছিল রাতটি। একমাত্র ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যাকাণ্ড ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি চমৎকারভাবে সাজানো। ৪ ঘণ্টা যাবৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকার নির্মম হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমি দেখলাম।

সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অগ্নিশিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছে। একসময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধুম্রকণ্ডলী ছড়িয়ে পড়লো কিন্তু তারপর মুহূর্তেই সেটি ছড়িয়ে পড়লো লকলকে অগ্নিশিখায়। যেন তারকাপুঞ্জকে স্পর্শ করতে চাইছে। মনুষ্যসৃষ্ট এই অগ্নিকুণ্ডের পাশে চাদের আলো ম্লান হয়ে গেলো।

প্রায় রাত ২টার দিকে বেতারযন্ত্র আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করলো। আমাকে বার্তাটি গ্রহণের আদেশ দেওয়া হলো। বেতার যন্ত্রের অপর পাশে ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে। তাকে প্রচণ্ড প্রতিরোধে মুখোমুখি হতে হয়েছে।

সেই মুহূর্তেই একজন সিনিয়র অফিসার আমার হাত থেকে যন্ত্রটি কেড়ে নিলেন ও মাউথপিসটা মুখের সামনে এনে চিৎকার করে বললেন, লক্ষ্যকে ধ্বংস করতে তোমার কতক্ষণ লাগবে? চারঘণ্টা, ননসেন্স কি কি অস্ত্র আছে তোমার কাছে? রকেট ল্যান্সার, রিকওয়েলস রাইফেলস, মর্টার! ঠিক আছে সবগুলোই ব্যবহার করো ও মাটির সাথে গুড়িয়ে দাও।

আরও পড়ুন: জীবন সংগ্রামে হার না মানা সূর্যবানু

২৫ মার্চের কালো রাতের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য টিক্কা খান তার হায়েনা সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়ে সারারাত অফিসে জেগে ছিলেন সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য অনুযায়ী, ২৬ মার্চের সূর্য ওঠার আগেই সৈনিকরা তাদের মিশন সমাপ্তির রিপোর্ট প্রদান করলো।

জেনারেল টিক্কা ভোর ৫টায় সোফা ছেড়ে উঠলেন ও নিজের অফিসে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ রুমাল দিয়ে নিজের চশমার কাচ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে এলেন। ভালো করে চারদিকে দেখে বললেন, একটা মানুষও নেই! আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কিরকম নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে তার বর্ণনাও উঠে এসেছে সিদ্দিক সালিকের বয়ানে, ২৬ মার্চ সকাল হতে হতেই আমি ঢাকা নগরীর প্রধান প্রধান রাজপথ ঘুরে বেড়ালাম। নজরে এলো বিসদৃশ মৃতদেহগুলো পরে আছে ফুটপাতের উপর কিংবা কুন্ডলী পাকানো অবস্থায় রাস্তার কোণে।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণকবরগুলো দেখছিলাম। সদ্যতোলা মাটি দিয়ে সেগুলো ভরাট করা হয়েছে। কোনো অফিসারই মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাইলো না। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমি তাড়াতাড়ি ক্যান্টনমেন্ট ফিরে এলাম। দেখলাম স্বস্তির সঙ্গে চেয়ারে গা এলিয়ে অফিসাররা গল্প করছে অফিসারস মেসে।

আরও পড়ুন: বিশ্বরেকর্ড করতে আগুন খান নাসার প্রকৌশলী

কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বললেন, বাঙালিদের ভালো করে শায়েস্তা করা হয়েছে। অন্তত তাদের বংশধররাও আর মাথা তুলবে না। মেজর মালিক তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বললেন, হ্যাঁ ওরা শুধু শক্তির ভাষাকেই বুঝে ওদের ইতিহাসও ঠিক এই কথাই বলে।

সিদ্দিক সালিকের বর্ণনার সঙ্গে বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফার বর্ণনা মিলে যায়, তিনিও ২৬ মার্চ সকাল থেকে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়ে হত্যাযজ্ঞের যে নির্মম দৃশ্য দেখেছেন। সেই বর্ণনা দিয়েছেন হারানো লেখা বইয়ে-

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলাম। যেতে যেতে দেখতে হলো অনেকগুলো লাশ কারও পিঠে লেগেছে গুলি, কারও বুকে। কোনো লাশের খুলির ভিতর দিয়ে গুলি গিয়ে মগজ বেড়িয়ে গিয়েছে। রেলওয়ে হাসপাতালের কাছে দিয়ে যেতেই একটা করুণ দৃশ্য দেখলাম একটা মায়ের স্তনে গুলি লেগেছে শিশুটি তখনও জীবিত।

আমরা যেন জাতির গোরস্তানের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছি। নার্স হোস্টেলের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে অবিশ্রাম কান্নার শব্দ ভেসে আসছে বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারিক চিৎকার করে বললেন এই ব্লকে কেউ বেচে নাই। আমরা ভিতরে গেলাম দেখলাম নিহত হয়েছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনিরুজ্জামান।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর ৮ জন্মদিন কেটেছে কারাগারে

ইংরেজি বিভাগের রিডার ড. জ্যাতির্ময় গুহ ঠাকুরদার ড্রাইভার বললো, ড. ঠাকুরদার কাধে গুলি লেগেছে আর ড. মফিজুল্লাহর কোনো খোজ নেই। পদার্থবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক ড.ইন্নাস আলীও গুলিবিদ্ধ।

জগন্নাথ হলের ছাত্রদের যখন নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিলো তখন দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব সেখানে ছুটে যান। বর্বর হায়েনা সেনাদের তিনি অনুরোধ করেন, বাবারা তোমরা আমাকে মেরো ফেল কিন্তু আমার নিরপরাধ ছাত্রদের মেরো না। হায়েনারা ড. দেবকে হত্যা করে এমনকি তার পরিবারের সব সদস্যদেরকেও হত্যা করে।

ইপিআরের হেড কোয়ার্টারে এই ক্যাম্পে ২৫০০ জন ইপিআর সদস্য থাকতেন। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। একজন পানের দোকানদার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ২৫০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে গিয়েছেন।

কেউ একজন বললেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যরা অর্ধেক রাত পর্যন্ত লড়াই করেছে পুলিশের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা টিকতে না পেরে ট্যাংক নিয়ে আসে। ট্যাংকের কামান দেখে পুলিশরা ছত্রভঙ্গ হয়।

রাজারবাগের হাজারখানেক পুলিশের মধ্যে মাত্র নাকি শ’খানেক কোনোমতে প্রাণে বাঁচতে পেরেছে। বাকি সবাই হায়েনাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। স্থানীয় লোকজন বললো শেষরাতে সব লাশ গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছে সৈন্যরা।

এসব বর্ণনা থেকে বুঝতে আর বাকি থাকে না ২৫ মার্চের কালো রাত্রে বাঙালির কত রক্ত ঝরেছে। পৃথিবীর আর কোথাও একরাতের মধ্যে এ রকম হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়নি।

আরও পড়ুন: ভূমিকম্প হলে দ্রুত যা করবেন

বঙ্গবন্ধু নিজেও ধারণা করেছিলেন ইয়াহিয়া টিক্কা খানকে দিয়ে একটা গণহত্যা চালাবেন এমনকি তাকেও হত্যা করা হবে। ২৫ মার্চ বিকেলে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে তার দেখা হলে তিনি তাকে বলেছিলেন, ইয়াহিয়া মনে করেছে যে আমাকে হত্যা করলেই সে আন্দোলন ধ্বংস করে দিতে পারবে।

কিন্তু সে ভুল করছে আমাকে হত্যা করলে আমার কবরের উপর স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বললেন, নতুন প্রজন্ম এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে আর আলোচনা সম্ভব নয়।

সে কারণে অনেক আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। আর এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ড. কামাল হোসেন, রেহমান সোবহান ও তাজউদ্দিন আহমেদের উপর। আর ২৫ মার্চ তিনি যখন নিশ্চিত হলেন যে, গ্রেফতার হবেন তখন স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ইপিআরের কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

ঘোষণাটি পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গে প্রচার হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টসে ওই ঘোষণাটির পূর্ণ বিবরণ আছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে-

আরও পড়ুন: ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস আজ

এই হয়তো আপনাদের সঙ্গে আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজ থেকেতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহবান জানাচ্ছি যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন ও হাতে যা কিছু আছে তাই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান, যতদিন না পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশ থেকে বহিস্কৃত হচ্ছে ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হচ্ছে।

এই ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহীত হওয়ার এক ভাষণে ২৫ মার্চ রাতের কথা স্মরণ করে বলেন, যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার আর সময় নেই ও আমার সোনার দেশকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তখন আমার মনে হলো এই বুঝি আমার শেষ। তখন আমি চেষ্টা করেছিলাম, কেমন করে বাংলার মানুষকে এই খবর পৌছিয়ে দেই এবং আমি তা দিয়েছিলাম তাদের কাছে।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় রাত আনুমানিক দেড়টা। তাকে গ্রেফতারের অভিযানটির দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান। এ অভিযানের কাহিনী নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন নাম ‘দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ’।

বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, মুজিবকে গ্রেফতারের জন্য তিনি তার সৈন্যদের দুটি দলে ভাগ করেন। একদল বাড়ির বাইরে, আরেক দল দেয়াল টপকে প্রবেশ করে। বাড়িতে কয়েকজন গার্ডের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়, এতে একজন গার্ড নিহত হয় ও বাকিরা বন্দী হয়।

আরও পড়ুন: দেশে টাকার চল শুরু হয় যেদিন থেকে

সৈন্যরা সিঁড়ির কাছে পৌঁছালে সেখানে আরেকজন গার্ডকে বন্দী করা হয়, কিন্তু তার পোশাকে লুকিয়ে থাকা একটি দা দিয়ে সে একজন সৈন্যকে আঘাত করে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর পুরো বাড়িটা ছিলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন সৈন্যরা প্রতিটি রুমের বন্ধ দরজায় আঘাত করতে থাকে এক পর্যায়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মুজিব নিজেই দরজা খুলে বেড়িয়ে আসেন, তখন মেজর খান ওয়াজির নামক একজন হাবিলদার তাকে একটি থাপ্পড় দেন।

মুজিব আমাকে বললেন, আমি পরিবারের লোকজনের কাছে থেকে বিদায় নিতে পারবো কি না! আমি তাকে বললাম, পারবেন তিনি ঘড়ের ভিতরে ঢুকলেন ও একটু পরেই বেড়িয়ে আসলেন। আমি তাকে নিয়ে নিচে নামলাম গাড়িতে ওঠার জন্য। ঠিক ওই সময় তিনি আমাকে জানালেন তিনি তার পাইপটি আনতে ভুলে গিয়েছেন। আমি তাকে নিয়ে আবার বাড়িতে গেলাম ও তিনি পাইপ নিলেন।

আমি ইস্টার্ন কমান্ডে মেসেজ পাঠালাম মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়ারলেস মারফত বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিলো বড় পাখিটি খাচার ভিতর ছোটগুলো নীড়ে নেই ওভার...

আরও পড়ুন: নেতাজীকে বাঁচাতে স্বামীকে হত্যা করেছিলেন নীরা

এই পাখির বর্ণনা নিয়ে লে. জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ বইয়ে লিখেছেন, আমার মেয়ে রুবিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়াশোনা করতেন। তাকে আমি আগেই লাহোরে পাঠিয়ে দেই। তাকে একথা বলে দেই যদি টেলিফোনে তার সঙ্গে আমার অথবা তার মায়ের কখনো কথা হয় তাহলে মুজিবের প্রসঙ্গ উঠলে মুজিব শব্দটি না বলে বলবে ময়না, এটি একটি সাংকেতিক শব্দ।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার বাসায় একটা ময়না পাখি আছে, যেটি সিলেট থেকে আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছিলো। ২৫ মার্চ গোলাগুলির প্রচুর শব্দে ময়নাটি মারা যায়। গভীর রাতে যখন মেয়ের সঙ্গে আমার স্ত্রীর কথা হয় তখন, রুবিনাকে সে বলে বেচারা ময়না মরে গিয়েছে। আমার কন্যা ভাবলো মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। রাত গভীর হলেও পুরো লাহোর শহরে এটা ছড়িয়ে পড়লো মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।

জেএমএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।