ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

জান্নাত শ্রাবণী
জান্নাত শ্রাবণী জান্নাত শ্রাবণী , সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০১:২৯ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
শীতের সকালে জীবিকার তাগিদে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন চালকরা, ছবি: মাহবুব আলম

ঢাকার ভোরের কুয়াশা যেন শহরটিকে ঢেকে রেখেছে এক নিঃশব্দ আবরণের আড়ালে। রাস্তায় মানুষ আসে যায়, কিন্তু তাদের চোখে পড়ে না এই কুয়াশার আড়ালে লুকানো এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র। ফুটপাতের রিকশাচালক, ভ্যানচালক, হকার, শিশু ও বৃদ্ধ সবাইকেই শীতের তীব্রতা মোকাবিলা করতে হয় জীবিকার সঙ্গে লড়াই করে। হাত ও পা শীতের আঘাতে জমে যায়, গলায় কাঁপন, কাঁধে ভোরবেলার ভার এরা কেউ কখনো দেখায় না তাদের কষ্ট।

ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

শীতে ঢাকার এই অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ তাজা কম্বল বা গরম চা থেকে বঞ্চিত, কেউ আবার একমাত্র রিকশায় বসে ঘামের বিনিময়ে সংসার চালায়। শহরের উজ্জ্বল আলোয়, ব্যস্ত রাস্তায় এরা যেন অদৃশ্য; কিন্তু তাদের প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে জীবন রক্ষার সংগ্রাম। এই গল্প সেই মানুষের যারা শীতের আড়ালে নগরীর ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন নিজেকে জিতিয়ে রাখে জীবন ও জীবিকার এক অব্যক্ত যুদ্ধে।

ঢাকার শীত এখানে ‘হিমের ঢেউ’ আকারে আসে, যা শহরের গলির মানুষের জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশাচালক বলেন, শীত পড়লেই কাজ কমে যায়। সকালে যাত্রী পাওয়া যায় না, বিকেলের দিকে কিছু মানুষ বের হয়, তাতে কিছুটা চলতি। কিন্তু এতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পরেছে।

ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

ঢাকার শীতের তীব্রতা শুধু তাপমাত্রা নয়। শহরের কুয়াশা, বাতাসের আর্দ্রতা এবং গ্যাস সরবরাহের সীমিততা সব মিলিয়ে মানুষকে শীতের সঙ্গে লড়তে বাধ্য করে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য প্রতিটি দিন একটি যুদ্ধ।

সড়ক পাশে, ফুটপাতের দিকের ছোট্ট দোকানগুলোতে দেখা যায় অন্যরকম দৃশ্য। আড়ম্বরহীন চা দোকান, যেখানে চা বিক্রির পাশাপাশি রুটি বা ছোট প্যাকেট বিস্কুট বিক্রি হয়, সেই দোকানের মালিক বলেন, ‘শীত পড়লে বিক্রি কমে যায়। মানুষ একটু বাইরে বের হতে দ্বিধা করে। ভেতরের লোকজনও কাজের চাপ বেশি, তাই চা-রুটি খেতে কম আসে।’ এ ধরনের দোকানগুলোতে প্রতিদিন কয়েকশ টাকার মতো আয় হলেও শীতকালে তা অর্ধেকেরও কমে যায়। ভোক্তাদের কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানিদের খরচও সীমিত। অনেক সময় দারিদ্র্যকে সামলাতে রাতের খাবারও কমিয়ে দিতে হয়।

আরও পড়ুন: 

 

আরেকদিকে রিকশা, ভ্যান, বা হকারদের জীবনের গল্প কিছুটা ভিন্ন। শীতের ভোরে তাদের হাত ও পা শীতের আঘাতে কঠিন হয়ে যায়। গলির কোণে দাঁড়িয়ে ভোরবেলা অপেক্ষা করা যাত্রীদের জন্য ঘাম ঝরানো একমাত্র উপায়। কিন্তু তাপমাত্রা যখন নেমে যায় ১০–১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে, তখন এই অপেক্ষা শারীরিকভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে।

ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

শীতের তীব্রতা শুধু শ্রমজীবী মানুষদের কষ্ট দিচ্ছে না; এটি শিশু এবং বৃদ্ধদের জীবনকেও প্রভাবিত করছে। ভ্যাকসিনেশন না হওয়া শিশু, অপুষ্টির শিকার পরিবার এবং কম সুবিধা সম্পন্ন বৃদ্ধদের জন্য শীত জীবনসংকট তৈরি করে।

ঢাকা শহরের বড় অংশে সঠিক স্যানিটেশন এবং রোডইনফ্রাস্ট্রাকচার না থাকায় শীত আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ফুটপাতের মানুষরা বরফ ঠান্ডা পানিতে হেঁটে কাজ করতে বাধ্য হয়। আবার সামাজিক নিরাপত্তা প্রায় নেই। সরকার বা স্থানীয় এনজিওগুলোর সহায়তা সীমিত। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতের ছবি যেন এক ‘শীতকালীন যুদ্ধক্ষেত্র’ এর প্রতিচ্ছবি। যেখানে মানুষ খোঁজে না চুলা, না কম্বল, বরং খুঁজে বের করে জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য।

ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

শ্রমজীবী, হকার এবং ফুটপাথের মানুষ তাদের জীবনকে শীতের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে টেনে আনে। এই মানুষদের প্রতিদিনকার সংগ্রাম চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তাদের গল্প শুনলে বোঝা যায় কতটা কঠিন জীবন।

শীতের সময় খেটে খাওয়া মানুষদের সাহায্য করার জন্য স্থানীয় এনজিও, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপরা কম্বল, গরম কাপড় এবং খাবারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এটি খুবই সীমিত। সঠিক নীতি এবং সরকারি উদ্যোগের অভাব শীতকালীন দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। একটি সুসংগঠিত ‘শীতকালীন সাহায্য কর্মসূচি’ শহরের এই মানুষদের জন্য যেমন জীবনধারণ সহজ করবে, তেমনি স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাবে। এছাড়াও, গ্যাস সরবরাহের নিয়মিত ব্যবস্থা, ফুটপাতের হকারদের জন্য সেলফ-হেল্প গ্রুপ তৈরি এবং শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য নিরাপদ উষ্ণ আশ্রয় সবই প্রয়োজন।

ঠান্ডার আড়ালে নগরীর অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র

ঢাকার শীত কেবল তাপমাত্রার নাম নয়; এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। রাস্তায় দাঁড়ানো রিকশাচালক, ফুটপাথের হকার, শিশুরা, বৃদ্ধ এরা সবাই শীতের কঠোরতা সামলে জীবনকে টানছে। এটি এক মানবিক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ লড়ছে জীবিকার জন্য, জীবনকে বাঁচানোর জন্য। সামাজিক সহমর্মিতা, সরকারি উদ্যোগ, এবং সচেতন নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া এই মানুষদের কষ্ট কিছুতেই কমানো সম্ভব নয়।

জেএস/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।