বিদেশে নার্স পাঠানোর নতুন দুয়ার ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:৪৩ এএম, ২৭ আগস্ট ২০২৫
আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ

নাটোর শহরের অদূরে, সবুজ শস্যক্ষেত আর শান্ত গ্রামীণ পরিবেশের মাঝেই গড়ে উঠেছে এক নতুন সম্ভাবনার বাতিঘর ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’। দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ প্রাণ-আরএফএল পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজ কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি উত্তরবঙ্গের নারীদের কর্মসংস্থান, আত্মমর্যাদা ও স্বাস্থ্যসেবায় দক্ষতা অর্জনের নতুন দিগন্ত।

একজন শিক্ষার্থীর গল্প

নাটোরের লালপুর উপজেলার অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে নুসরাত জাহান। বাবা ছোট ব্যবসায়ী, সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। তবুও উচ্চমাধ্যমিকের পর তার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন সীমিত হলো আর্থিক বাস্তবতায়। পরিবার ভেবেছিল নুসরাত হয়তো পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

বিদেশে নার্স পাঠানোর নতুন দুয়ার ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’

নুসরাতের ভাষায়, ‘আমি হয়তো ডাক্তার হতে পারিনি, কিন্তু নার্স হয়েও মানুষের সেবা করতে পারবো। বিদেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পেলে পরিবারকে সচ্ছল জীবন দিতে পারবো।’

প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খান চৌধুরী সারাজীবন কাজ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নে। নাটোরে তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের পাশাপাশি পরিবারের উদ্যোগে চালু হয়েছে নার্সিং কলেজ। এর নেতৃত্বে আছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (ফিন্যান্স) উজমা চৌধুরী।

তিনি বিশ্বাস করেন, ‘আজ আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি গৃহকর্মী, এমনকি অদক্ষ শ্রমিকও। অথচ প্রশিক্ষিত নার্স পাঠাতে পারলে তাদের মর্যাদা ও আয় দুটোই বহুগুণ বাড়বে। আমাদের মেয়েদের সামর্থ্য আছে, শুধু প্রয়োজন সঠিক সুযোগ।’

নার্সিং পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন নার্সিং পেশাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সমাজে ডাক্তারকে ‘মূল চিকিৎসক’ মনে করা হলেও নার্সদের গুরুত্ব কমিয়ে দেখা হয়। অথচ স্বাস্থ্যসেবার মূল দায়িত্ব নার্সরাই পালন করেন।

একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘ডাক্তার হয়তো রোগীকে দিনে একবার দেখে যায়, কিন্তু নার্স ২৪ ঘণ্টা তার সেবায় নিয়োজিত থাকেন। রোগীর সুস্থ হওয়ার অর্ধেক কৃতিত্ব নার্সের। তবুও তাদের প্রাপ্য সম্মান আমরা দিই না।’

বিদেশে নার্স পাঠানোর নতুন দুয়ার ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’

আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ এই ধারণা বদলাতে চায়। প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য—নার্সিংকে মর্যাদাপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

অবকাঠামো ও শিক্ষার মান

কলেজে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে আধুনিক ভবন, প্রশিক্ষণ ল্যাব, সিমুলেশন সেন্টার ও সুসজ্জিত লাইব্রেরি। শিক্ষার্থীরা সরাসরি সংযুক্ত থাকবেন আমজাদ খান চৌধুরী মেমোরিয়াল হাসপাতালের সঙ্গে, যেখানে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হবে।

এছাড়া এখানে ভাষা শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সিলিংয়ের সুযোগও রাখা হয়েছে। কারণ, শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, বরং মানবিক গুণাবলিই একজন ভালো নার্স হওয়ার মূল শর্ত।

২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’। ২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্মার্ট ল্যাবে সমৃদ্ধ এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে নার্স হতে যাচ্ছেন ১৩০ জন। এখন নার্সিং কলেজে সরকারি নিয়মে ৮০ শতাংশ মেয়ে নিতে হয়। ছেলে ২০ শতাংশ।

কর্মসংস্থানের সুযোগ

সৌদি আরব প্রাণ গ্রুপের মাধ্যমে প্রায় ২০০-২৫০ জন নার্স নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। জাপান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশেও সম্ভাবনার দুয়ার খোলা। তবে এর শর্ত হলো ভাষাজ্ঞান—আরবি ও ইংরেজি। এজন্য কলেজে আলাদা ভাষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

বিদেশে নার্স পাঠানোর নতুন দুয়ার ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার নার্স প্রয়োজন হলেও তৈরি হয় তার অর্ধেক। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ৮০ লাখ নার্সের চাহিদা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নাটোরের এই কলেজ সেই বিশাল সুযোগ কাজে লাগাতে চায়।

নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক পরিবর্তন

প্রাণ গ্রুপ আগে থেকেই নারী কর্মসংস্থানে পথিকৃৎ। তাদের কারখানাগুলোতে কর্মরত প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নারী। এবার নার্সিং কলেজের মাধ্যমে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হলো।

একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা আগে শহরে গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করতো। এখন নার্সিং শিখে তারা সম্মানজনক পেশায় যুক্ত হতে পারছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাবে।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

• আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন
• বিদেশি শিক্ষকদের নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ
• বিশেষ স্কলারশিপ কর্মসূচি
• নাটোরকে ‘নার্সিং রপ্তানি কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তোলা

বিদেশে নার্স পাঠানোর নতুন দুয়ার ‘আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ’

উজমা চৌধুরী স্বপ্ন দেখেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া। আমরা চাই, নাটোর থেকেই একদিন দক্ষ নার্স রপ্তানির জন্য বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনুক।’

আমজাদ খান চৌধুরী নার্সিং কলেজ এখনো শুরুর পথে। তবে এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে নার্সিং শিক্ষায় এক নতুন আলো ছড়াচ্ছে। এটি শুধু নাটোর নয়, সমগ্র উত্তরবঙ্গের নারীদের আত্মনির্ভরতার পথ দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠছে এই কলেজ।

এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।