ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, সাদা ফোঁটা দেখে চেনা যায় এডিস মশা
ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, একটি গান আছে, ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, সাদা সাদা ফোঁটা দেখে এডিস মশা চেনা যায়।’ এই মশা চিনতে হবে। এই মশাই ডেঙ্গুর জন্য দায়ী।
শনিবার (৩ জুন) সকাল ১০টায় বিএসএমএমইউ’র শহীদ ডা. মিলন হলে ডেঙ্গুর পরিবর্তনশীল প্যাটার্ন ও উপসর্গ নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেন তিনি। সেমিনারের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগ।
উপাচার্য বলেন, গত বছর প্রায় ৬২ হাজার জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর মারা গেছেন ২৮১ জন। এবছর জুন-জুলাই আসার আগেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দুই হাজার জন। এরই মধ্যে ১৩ জন মারা গেছেন যা উদ্বেগের বিষয়।
তিনি বলেন, নতুন বিল্ডিং তৈরি ও উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় এবং বৃষ্টির পর ছাদে পানি জমে থাকে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে দায়ীদের জরিমানা করা যেতে পারে। বাড়ির পেছন পরিষ্কার রাখতে হবে। খালি পাত্র থাকলে তা উল্টো করে রাখতে হবে, যাতে পাত্রের ভেতরে পানি জমে না যায়। শরীরে ফুল হাতার শার্ট ও পায়ে মোজার ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। ডেঙ্গু হয়েছে কি না তা জানতে জ্বর হলে শুরুতেই এনএস ওয়ান টেস্টটি করে নিতে হবে এবং জ্বর হলেই অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ফলমূলসহ পানি জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। ডেঙ্গু প্রথমবার হলে মৃত্যুহার কম। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার হলে মৃত্যুহার বেশি। যারা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন তাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগ প্রতিরোধে এডিস মশা নিধন, ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাইডলাইন অনুসরণের পাশাপাশি রোগ ও রোগীর অবস্থাভেদে চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সেমিনার শেষে কেবিন ব্লকের সাধারণ জরুরি বিভাগে ডেঙ্গু কর্নার উদ্বোধন করা হয়।
সেমিনারে বলা হয়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রথম প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ ছিল জ্বর, কাশি, র্যাস ও মাথাব্যথা হওয়া। কিন্তু ২০২১ সালের পর ডেঙ্গুর উপসর্গ পরিবর্তন হয়। তখন ডেঙ্গুতে নতুন উপসর্গ পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানায় যোগ হয়। এটি এখনো চলমান।
সেমিনারে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হন ৬১ হাজার ৭৬৩ জন। ২৮১ জন মারা যান। যা অতীতের তুলনায় সর্বাধিক। ২০২৩ সালে ২ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৭৯৩ জন এবং মারা যান ১৩ জন। ২০২৩ সালে জানুয়ারিতে ৫৫৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন ও মে-তে ৭৮৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, জ্বর হলে প্রথম দিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা এনএস ওয়ান করাতে হবে। ডেঙ্গুজ্বর ধরা পড়লে পর্যাপ্ত পানি জাতীয় খাবার এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ নিতে হবে। অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকবেন। এসময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ও ব্যথার ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। বমি, পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে কোথাও রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট অথবা রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই উত্তম। এজন্যে মশারি ব্যবহার, বাচ্চাদের ফুল হাতা জামা পরানো, বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, জ্বর হলে প্রয়োজন ছাড়া অযথা বাড়তি টেস্ট এবং বার বার টেস্ট যেন না দেওয়া হয়। ডেঙ্গুজ্বরের কারণে প্লাটিলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে এই ধারণা ভুল। আবার রক্ত দেওয়া যাবেই না এটাও ঠিক না। রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন কী করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গু ও কোভিডে একই ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। উভয় রোগেই দেখা যায় জ্বর ও সর্দি-কাশির লক্ষণ। এজন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গু ও কোভিড পরীক্ষা করাতে হবে। বর্তমানে পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীও অনেক পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য জ্বর হলেই প্রথম দিন এনএস ওয়ান টেস্টটি করাতে হবে। শুরুতে রোগ চিহ্নিত না হলে ও রোগীর অবস্থার অবনতি হলে তাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এএএম/জেডএইচ/এএসএম