‘বিদ্রোহী’ কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার নাম। যে কবিতা প্রকাশের একশ বছর অতিক্রম করেছে। এই একটি কবিতা কবিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি এনে দিয়েছে। একশ বছরেও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে কবিতাটি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কবিতা পাঠ করছে। একজন কবির জীবনে এমন একটি কবিতাই যথেষ্ট। যে রাতে তিনি কবিতাটি লিখেছেন, সে রাতে হয়তো তিনি ভাবেননি—কবিতাটি তাকে বিখ্যাত করে তুলবে। কবিতাটি একশ বছর অতিক্রম করবে। একশ বছর পর এসে আমরা বলতে পারি, কবিতাটি পৃথিবী ধ্বংসের আগপর্যন্ত টিকে থাকবে।
Advertisement
কেন মানুষ বিদ্রোহী কবিতা পড়ে? কেন একশ বছর পরও মানুষ বিদ্রোহী কবিতা পড়বে? সহজে বলতে গেলে, কবিতার কথাগুলো আমার, আপনার, সবার। তাই হয়তো এমন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। যে কবিতায় পাঠক তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো খুঁজে পান, মনের অপ্রকাশিত বাসনা ধরা দেয়—সেই কবিতাই পাঠককে আকৃষ্ট করে। নজরুল ইসলাম কাজটি ঠিকঠাক করতে পেরেছিলেন। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মনের কথাই কবিতাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কবিতার কথা, সুর, ছন্দ নাড়া দিয়েছে পাঠকের মনে। ঝংকার তুলেছে কণ্ঠে।
কাজী নজরুল ইসলাম যখন বিদ্রোহী কবিতা লেখেন; তখন তিনি ২২ বছরের তরুণ। উনিশ শতকের বাংলা কবিতায় উপনিবেশিকতার ছায়া স্পষ্ট। কবিতার প্রেক্ষাপট এ তথ্য দেয় যে, সাংস্কৃতিকভাবে উপনিবেশিত বাংলায় কবিতাও ছিল উপনিবেশিত সৃষ্টি। অবশ্য ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে এড়িয়ে যেতে পেরেছিল নিম্নবর্গের সাহিত্যিক সৃষ্টি—কবিগান, পালাগান, কথকতা ইত্যাদি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এগুলোকে যথাসম্ভব এড়িয়ে গিয়েছে। (বাংলা কবিতার মানচিত্রে ‘বিদ্রোহী’)
কিন্তু গত একশ বছরে পৃথিবীর জল অনেক গড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্ব কবিতা পরিবর্তিত হয়েছে। দেশে দেশে জাতীয় সাহিত্যের ধারণা তৈরি হয়েছে। এই ধারণায় নজরুলের গণমুখী ও প্রতিরোধী নন্দনতত্ত্ব আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় মানুষের পৃথিবী যেভাবে অধিকাংশ মানুষের পৃথিবীর মধ্যে ঢুকে পড়ছে এবং অধিকাংশের পৃথিবীকে নাই করে দিচ্ছে তাতে কবিতাকে নজরুলীয় নন্দনের কাছে হাত না পেতে উপায় নেই। এ কারণেই বোধ করি ‘বিদ্রোহী’ বাংলা কবিতার ক্লাসিক হয়ে উঠেছে এবং আরও বহুকাল আদরণীয় হয়ে রইবে। (‘বিদ্রোহী’ কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক রাজনীতি)
Advertisement
কবিতাটি লেখা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। আর ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। প্রকাশের পর পরই কবিতাটির পাঠকপ্রিয়তার কারণে পত্রিকাটি পুনরায় ছাপতে হয়। দুই বারে পত্রিকাটি মোট ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়, যা সেই সময়ের জন্য একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই হইচই পড়ে যাওয়া কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগের কথা। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। তবে কবিতাটির প্রথম প্রকাশ নিয়ে মতভেদ আছে। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘বিদ্রোহী কবিতা বিজলীতে প্রকাশেরও আগে ‘মোসলেম ভারত’-এ প্রকাশিত হয়।’
প্রথম প্রকাশের বিষয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। তবে কবিতাটি প্রথম ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত ‘অগ্নিবীণা’ বইয়ে ১১টি কবিতার সাথে সংগ্রহ করা হয়েছিল। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতন থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে নজরুল ও মুজফ্ফর আহমেদের ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ঘটনা ঘটে। একটি হলো ভারতের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন। অপরটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা। তালতলা লেনের এ বাড়িতে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং নজরুলের ‘ভাঙ্গার গান’ ও ‘বিদ্রোহী’ রচনা একই বাড়িতে একই সময়ের ঘটনা।’
পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নেবে বলেই সেদিন কবিতাটি রচিত হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা বিশেষ ক্ষমতাবলে কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়ে কবিতাটি লিখিয়ে নিয়েছেন। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে এই শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দী) তৃতীয় দশকের গোড়ায় একবার কিন্তু এমনি অকস্মাৎ তুফানের দুরন্ত দোলা লেগেছিল।... মনে আছে, বন্ধুবর কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একটি কাগজ কোথা থেকে কিনে নিয়ে অস্থির উত্তেজনার সঙ্গে আমার ঘরে এসে ঢুকেছিলেন। কাগজটা সামনে মেলে ধরে বলেছিলেন, পড়। অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি। রাস্তায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে এ কাগজ নিয়ে।... কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে-ঘাটে রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে, কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে ছাপার অক্ষরই যেন কাগজে আগুন ধরিয়ে দেবে।... গাইবার গান নয়, চীৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এ দেশের তরুণরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতারই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।’ আর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্কপাতেরও অতিরিক্ত... গদগদ বিহ্বলের দেশে এ কে এল উচ্চ-বজ্রনাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল।’
আসলে সময়টিই ছিল বিদ্রোহের। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চিৎকার করার। উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার। কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহ করেছেন, কবিতার মাধ্যমে চিৎকার করেছেন, শব্দের মাধ্যমে অস্ত্র ধরেছেন। নির্জীব বাঙালির ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার ফলে শুধু বাংলা সাহিত্যই উপকৃত হয়নি; বাংলা ভূ-খণ্ডও উপকৃত হয়েছিল। কবিতার আমিত্বের মধ্য দিয়ে প্রতিটি মানুষের সত্তা জেগে উঠেছিল। তারা বিপ্লবের নতুন মন্ত্র লাভ করেছিল। তারপরও এক শ্রেণির মানুষ কাজী নজরুল ইসলামকে হেয় করার জন্য, বিতর্কিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। নজরুল ইসলামও তাদের জবাব দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম বরাবরই বলতেন, ‘আমি শরিয়তের বাণী বলিনি—আমি কবিতা লিখেছি। ধর্মের বা শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে কবিতাকে মাপতে গেলে ভীষণ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি বা কবিতা বাঁচেও না, জন্মও লাভ করতে পারে না।’
Advertisement
সেই সময়ে বিদ্রোহী কবিতাটি আকৃষ্ট করেছিল সবাইকে। যারা কাজী নজরুল ইসলামের এমন প্রতিভাকে মেনে নিতে পারেননি, তারা কেবল সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করেছেন। বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তখনকার আলেম সমাজকে ক্ষুব্ধ হতে সাহায্য করেছেন। তবে যারা মূল্যায়ন করা দরকার, তারা ঠিকই মূল্যায়ন করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিন সবার উপস্থিতিতে বলন, ‘নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ।’
বাঙালির মধ্যে সমালোচনার প্রবণতা খুব বেশি। কোনো কিছু না জেনে না বুঝেও তারা সমালোচনা করে। সমালোচনা করতে হয় বলে। সমালোচনা না করলে জাতে ওঠা যায় না বলে। কিন্তু যারা নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েছেন, তারা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছেন। কবিতার শক্তি তারা হৃদয়াঙ্গম করতে পেরেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রশংসা করে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘মনে হলো এমন কিছু আগে কখনো পড়িনি।’ অন্যত্র তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’
নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতাকে বেঁধেছেন ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। অসমান পঙ্ক্তির বিন্যাস দিয়ে বাক্যকে মুক্ত ও প্রবহমান করেছেন। অন্ত্যমিল থাকলেও রেখে দিয়েছেন অতি পর্ব। অপূর্ণ পর্ব সাদা পৃষ্ঠার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসমান পঙ্ক্তির কালো অক্ষর। এ অসমতা, ছন্দের চঞ্চলতা তারুণ্য ও যৌবনের উদ্দীপনাকে ইশারা করে। কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয়, ছন্দ-নিরূপিত পথে পাঠক ছুটছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক ‘আমি’র চিত্রপট থেকে অন্য চিত্রপটে; এক ‘আমি’র বিন্দু থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বহুরৈখিক আলো। ১৪১ লাইনের কবিতাটিতে ১২১ বার ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে কবি একটি কথারই প্রতিধ্বনি করতে চেয়েছেন যে, মানুষ অসম শক্তির অধিকারী।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথকে নতুন ভাবে রূপদান করেছেন। পৌরাণিক অনুষঙ্গ ও মিথের ব্যবহার তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি হিন্দু, মুসলিম, গ্রীক প্রভৃতি পুরাণ ও মিথ ঐতিহ্যকে নতুন ভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতায় পুরাণ ও মিথ ব্যবহারকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া যায়। তথা:১. ভারতীয় মিথ-পুরাণের ব্যবহার।২. বাংলার লোক-পুরাণের ব্যবহার।৩. ইউরোপীয় মিথের ব্যবহার।৪. ইসলামি মিথের ব্যবহার।৫. মধ্যপ্রাচ্যীয় মিথিক উৎসের ব্যবহার।
ভারতীয় মিথ-পুরাণের ব্যবহার দেখা যায় বিদ্রোহী কবিতায়। যেমন- ১. ‘মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!’২. ‘আমি হোমশিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।’৩. ‘আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।’৪. ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার।’৫. ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন; আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।’
এ ছাড়া ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী’। এই শ্যাম বা কৃষ্ণ আমাদের দেশজ বাংলাদেশের কৃষ্ণ বা শ্যাম। ইউরোপীয় মিথের বহুল প্রয়োগ না থাকলেও দু’একটি অব্যর্থ ব্যবহার তাঁর কবিতায় লক্ষ্যণীয়। যেমন- ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি মহাসিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম ঘুম চুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম।’এখানে চিত্রকল্প হিসেবে মিথের প্রয়োগ ঘটেছে বিদ্রোহী কবির চৈতন্যের বিচিত্র অভীপ্সার অনুষঙ্গ হিসেবে।
ইসলামি ঐতিহ্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কাজী নজরুল ইসলামের শিল্পী-চৈতন্য অভিপ্রায়ের বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট। অবরুদ্ধ সমাজের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় জাগ্রত কবিচৈতন্য বিদ্রোহ ও প্রতিবাদকে যখন কাব্যরূপ দান করেছে, তখন ঐতিহ্য অনুষঙ্গও অনুরূপ ভাবব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি বলেছেন,১. ‘আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার’২. ‘ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি।’কাজী নজরুল ইসলামের কবিচৈতন্য মিথ-ঐতিহ্যের এই বহুমাত্রিক অঙ্গীকার নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময় এবং অভূতপূর্ব শিল্প এষণায় গৌরবমণ্ডিত। তাঁর জীবনবোধের কেন্দ্রীয় মীমাংসাটি হল শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের হাত থেকে মানবাত্মার মুক্তি অন্বেষণ। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতিশোষণ, শ্রেণিশোষণ, ধর্মশোষণের বিরুদ্ধে মানুষের শৃঙ্খলিত বিবেককে জাগ্রত করাই ছিল তাঁর জীবনমন্ত্র। জীবনার্থের এই বৈশিষ্ট্যই কবির মিথ ঐতিহ্য চেতনাকে করেছে মানবমুখী জীবনান্বেষায় ভাস্বর।
শুধু তা-ই নয়, তার এ বিদ্রোহের গভীরে আছে প্রেম। কেননা অন্তরে প্রেম না থাকলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা যায় না। ভালোবাসাই মানুষকে বিদ্রোহী বা বিপ্লবী করে তোলো। প্রেমই কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে। এই তীব্রতাই এক সময় বিদ্রোহের জন্ম দেয়। ফলে প্রেম ও বিদ্রোহ একে অপরের পরিপূরক হয়ে ধরা দেয়। ফলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহীর মতো কবিতা লিখতে পেরেছিলেন। সাক্ষী হতে পেরেছিলেন ইতিহাসের। তাই তো নজরুল ইসলাম আজও প্রাসঙ্গিক। সমকালীন তার বিদ্রোহী কবিতাও। কেননা প্রত্যেক বড় সাহিত্যিকের রচনার মধ্যে চিরন্তনতা এবং সমকালীনতা বিদ্যমান। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতায়ও আমরা প্রবল সমসাময়িকতা এবং চিরকালীনতা খুঁজে পাই। তার কালজয়ী কবিতায় যেসব মানবিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে, সেসবের অনেক কিছু এখনো বিরাজমান। যে কারণে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আরও বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
সবশেষে বলা যায়, বাংলা সাহিত্য একটি ইতিহাসের সাক্ষী হলো। বাংলা কবিতা একটি মাইলফলক স্পর্শ করল। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা সেই ইতিহাস ও মাইলফলক স্থাপনের হাতিয়ার হয়ে রইল। শত বছর থেকে সহস্র বছরে পা রাখবে কবিতাটি। সে প্রত্যাশা করতেই পারি।
তথ্যসূত্র:১. বিদ্রোহী, কাজী নজরুল ইসলাম, বিজলী, ১৯২২, কলকাতা২. অগ্নিবীণা, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৭২, ঢাকা ৩. ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক রাজনীতি, কুদরত-ই-হুদা, ৭ জানুয়ারি ২০২২, ডেইলি স্টার৪. বাংলা কবিতার মানচিত্রে ‘বিদ্রোহী’, সুমন সাজ্জাদ, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, প্রথম আলো৫. ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ ও সমাজ বাস্তবতা, হাফিজ বিন রহমান, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, সমকাল।
এসইউ/জিকেএস