মাহমুদ নোমান
Advertisement
ঠেস-কথার রসে পূর্ণ আর তুমুল ভাবনায় শব্দকে শ্রুতিধর ও ভাবকল্পে গায়েবি মদতদানকারী সাধক কবি কবীর হোসেন। কঠিনেরে সহজ-সরলে প্রকাশের তরিকা কবীর হোসেনের কবিতা। সম্প্রতি কবীর হোসেনের ‘বাছাই করা ১০০ কবিতা’ পাঠ শেষে মনে হলো—প্রত্যেকটি কবিতাই ঘোর লাগা মোড় পেরোতে পেরোতে পাঠককূলের মনে হবে, কবিতাটি লেখা শেষ হলো কেন শেষপর্যন্ত! আরও কতক্ষণ পাঠক নিজেকে সঁপে দিতে চান, মোহিত করার গুপ্ত কলাকৌশল ও বুনন মাহাত্ম্যে দোদুল্যমান শিখা কবীর হোসেনের কবিতার চিত্রকল্প। স্মার্ট শব্দগুচ্ছের আলো-আঁধারিতে কবীর হোসেনের প্রতিটা কবিতাই একেকটি ভ্রমণের গল্প। কবিতার অন্তর্নিহিত স্বভাবে শুরু থেকে শেষাবধি পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম ভাব ও ঘোরের মায়াবলে—
‘আমি যে বেঁচে আছি একথা এখন মিথ্যাই।
আগে নড়ে-চড়ে উঠতো বুকএখন নড়ে না
Advertisement
এমনকি লোমহর্ষক খুন, গণধর্ষণের খবর শুনেওচোখে পানি আসে না!
লুট হয়ে যেতে দেখলেও মানবতামুখে কোনো ফোটে না আওয়াজ।’(মিথ্যা; ইহলৌকিক বিষয়ক-১৫ পৃষ্ঠা)
খ.যেখানেই পৌঁছাই দেখি সেখানেই আমি নাই।অন্য কেউ বসে আছে আমার নামে।
আমার চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে এক নারীযার জন্য আমি যেকোনো কিছুই ছাড় দিতে পারি।
Advertisement
এমনকি যে ঠিকানায় যাইসেই ঠিকানাও বাস্তবে নাইজন্ম নেয়নি বাড়িওয়ালাই।
আমার নাম লিখে সার্চ দিলে বেরিয়ে আসে;আম, জাম, বৃক্ষপদ্মা, মেঘনা, যমুনাদোয়েল, কোয়েল, টিয়া।
আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েদেশ-বিদেশেও ঘুরে বেড়ায় অন্য কেউ।(আমি কেউ না; ইহলৌকিক বিষয়ক- ১৮ পৃষ্ঠা)
আরও পড়ুনক্রীতদাসের হাসি: তাতারীর আর্তনাদরোদনধ্বনি রক্তধ্বনি: দ্রোহের নীলে ফোটা সত্যি ফুল
০২কবিরা কবিতায় আড়াল রেখে অর্থাৎ নতুন বউকে ঘোমটা পরিয়ে তার সৌন্দর্য বিষয়ে কৌতূহল বাড়াতে তৎপর। এরপরে আসে উপস্থাপনা আর কবিতার মধ্যে বুনন। অর্থাৎ মাঠের খেলায় পারফর্মেন্সে পৃথক হয়ে যায় একেকজন কবি। কবিতা হচ্ছে উচ্চতর শিল্পকর্মই। এক সত্যকে অন্য সত্যে প্রতিস্থাপিত করে মূল বিষয়কে (মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা) গ্রহণযোগ্য করে তোলাই সমকালীন কবির উদ্দেশ্য আর এটাই সুররিয়ালিজম অর্থাৎ আড়াল কিংবা ঠেস কথা। নব্বইয়ের দশকের কবিদের মধ্যে কবীর হোসেনই সুররিয়ালিজমকে সুচারুরূপে সহজাত উপমায় উপস্থিত করেছেন।
ত্রিশ বছরের অধিক কাব্যিক যাত্রার ৯টি কবিতার বই ও অপ্রকাশিত কবিতা থেকে ‘বাছাই করা ১০০ কবিতা’ বইটি। সচরাচর বাছাই কবিতার বইয়ে পূর্বে প্রকাশিত বইয়ের নামানুসারে কবিতার বাছাই কিংবা বিন্যস্ত না করে বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ইহলৌকিক, পারলৌকিক, প্রেমের এবং সিরিজ কবিতায় করোনা, নদী ও পাখি বিষয়ক কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, জীবনঘনিষ্ঠ উচ্চারণে নির্ভীক মনোভাব কবীর হোসেনের। যা তিনি ছুঁয়েছেন, অনুভব করেছেন এবং ঘ্রাণ কিংবা স্বাদ নিয়েছেন। অর্থাৎ একজন কবীর হোসেনকে ভাব ও বোধের সবটুকুতে উপস্থাপন করেছেন।
লৌকিকতার সাঁকোতে হেঁটে গেছেন, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সার কথা ‘বাছাই করা ১০০ কবিতা’ বইয়ে—‘সবকিছুই অলীকদিনতারিখ উতরে যাওয়ার পর মানুষও মূলতটেবিলের ওপরে অচ্ছুৎ ডেস্ক ক্যালেন্ডার।’(মানুষ; পারলৌকিক বিষয়ক-৪৭ পৃষ্ঠা)
খ.কবিতা লেখার সময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি।তারপর যখন জাগিদেখি কে যেন আমার ডায়েরির খোলা পাতাটিতেলিখে রেখেছেন গোটা কবিতা এক।
আমার নয় অথচ আমারই মনে হয়এভাবে সব লেখাই কে যেন লিখে রাখে ডায়েরির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।যত পড়ি ততই অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়।(কবিতা লেখার সময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি; পারলৌকিক বিষয়ক-৫৭ পৃষ্ঠা)
সত্যিই তো কবিতা কোত্থেকে আসে কবিও জানেন না। অনেক সময় লেখার পরে কবিরও মনে হয় কবিতাটি কি আমিই লিখেছি! তাই তো বলি কবি আধ্যাত্মিকতার চাষা। লেখার প্রতি নির্মোহ, নির্ঝঞ্ঝাট কুশল কবীর হোসেনের বিশেষত্ব। কবীর হোসেন ব্যক্তিমনের বিচিত্রিত অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ, চিন্তন ও অনুভূতির বিশ্বস্ত বিশ্লেষণে ভালোবাসার কথাই বলতে চেয়েছেন। এ জন্যই করোনা বিষয়ক কবিতা লিখতেও লিখেছেন—‘একমাত্র বুকের ভেতর তৈরি পথ ছাড়া সব পথই লকডাউন।’ (লকডাউন; ৭১ পৃষ্ঠা)
কবীর হোসেন অন্তরে ভালোবাসার প্রজ্জ্বলিত শিখায় খুঁজেছেন সত্য উদ্ঘাটনের জ্ঞান; কবীর হোসেন মূলত জীবনঘনিষ্ঠ নির্ভেজাল কবি।
বইয়ের নাম: বাছাই করা ১০০ কবিতাকবি: কবীর হোসেনপ্রকাশনী: প্রতিকথা প্রকাশনাপ্রচ্ছদ: রাজিব রায়মূল্য: ২৫০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম