বিবিসির প্রতিবেদন

৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গোপনে সমুদ্রে ফেলে দেয় ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৫৬ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২৫
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বাসনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন ইউনাইটেড হিন্দু ফ্রন্টের (ইউএইচএফ) সদস্যরা/ ছবি: এএফপি

ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে আটক ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গোপনে জোর করে মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বর্ণনা অনুযায়ী, ভারতীয় পুলিশ তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য হালনাগাদের কথা বলে থানায় ডেকে নেয়, এরপর এসব রোহিঙ্গা নাগরিকদের অজ্ঞাত স্থানে পাঠানো হয়। পরে তাদের গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে মিয়ানমারের উপকূলে পৌঁছে যেতে বাধ্য করা হয়।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঘটনাটি শুরু হয় চলতি বছরের ৬ মে। দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত অন্তত ৪০ রোহিঙ্গাকে পুলিশ স্টেশনে হাজির হতে বলা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর তাদের ইন্দরলোক আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

৭ মে সকালে রোহিঙ্গাদের দলটিকে হিন্দন বিমানবন্দর থেকে বিমানে করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সামরিক পোশাক পরিহিত কয়েকজন তাদের চোখ ও হাত বেঁধে নৌবাহিনীর একটি জাহাজে তোলেন।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা জাহাজে রাখার সময় তাদের অনেককে মারধর করা হয়, মুসলিম ও খ্রিস্টান হওয়ার কারণে অপমানজনক কথা শোনানো হয়, এমনকি শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। খাবার দেওয়া হলেও মানসিক চাপ ও ভয়ের কারণে ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা নাগরিকদের বেশিরভাগই কিছু খেতে পারেননি।

নুরুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিক বলেন, কীভাবে কেউ মানুষকে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারে? বিশ্বে মানবতা থাকলেও ভারত সরকারের মধ্যে আমি কোনো মানবতা দেখিনি। তিনি আরও বলেন, আমার মা-বাবা ও অন্যরা যে যন্ত্রণার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা আমি সহ্য করতে পারছি না।

কিছু শরণার্থী নৌযানে সহিংসতা ও অপমানের শিকার হয়েছেন। সৈয়দ নূর নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করা হয়েছিল। কিছু মানুষকে মারধর করা হয়েছিল, ঘাড়ে চড় মারার ঘটনাও ঘটেছে।

ভিডিও কলের সময় ফয়াজ উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি তার ডান কব্জিতে দাগ দেখিয়ে বলেন, বারবার ঘুষি ও চড় দেওয়া হয়েছে। এমনকি, বাঁশের লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয়েছে। সেসময় তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কেন ভারতে অবৈধভাবে আছেন?

৪০ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন খ্রিস্টান। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেন হিন্দু হলেন না? কেন ইসলাম থেকে খ্রিস্টান হলেন? এমনকি, প্যান্ট নামিয়ে দেখা হয়, তাদের খৎনা হয়েছি কি না।

শেষমেশ, ৮ মে সন্ধ্যায় তাদের একটি ছোট নৌকায় করে সমুদ্রে নামানো হয়। পরে লাইফ জ্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করা হয়। বলা হয়, তারা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের কাছাকাছি আছেন। তবে পরদিন সকালে স্থানীয় জেলেরা তাদের উদ্ধার করে জানান, আসলে তারা মিয়ানমারে এসে পড়েছেন।

বর্তমানে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় একটি স্থানীয় বিদ্রোহী সংগঠনের তত্ত্বাবধানে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন।

জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষ প্রতিবেদক টমাস অ্যান্ড্রুজ জানিয়েছেন, অভিযোগগুলোর সত্যতা প্রমাণের মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তিনি এ বিষয়ে ভারত সরকারকে অবহিত করেছেন। তবে দিল্লি এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বিবিসি। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে, এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। যদিও প্রাথমিকভাবে আদালতের এক বিচারপতি অভিযোগকে ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে মন্তব্য করেন। মামলার পরবর্তী শুনানি ২৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত আছে।

ভারতে বর্তমানে আনুমানিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ হাজার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এ নিবন্ধিত। কিন্তু ভারত সরকার তাঁদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, বরং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করে। এ কারণে দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন, কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন।

সূত্র: বিবিসি

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।