ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ: ট্রাম্পের সহকারী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শীর্ষ সহকারী স্টিফেন মিলার দাবি করেছেন, ভেনেজুয়েলার তেল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির তেল শিল্প জাতীয়করণকে সরাসরি ‘চুরি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে হোয়াইট হাউজের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলায় তেল শিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকানদের ঘাম, উদ্ভাবন ও পরিশ্রমে’। তার ভাষায়, এই শিল্পের স্বৈরাচারী দখল ছিল আমেরিকান সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, এই ‘লুণ্ঠিত সম্পদ’ ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন করা হয়েছে ও যুক্তরাষ্ট্রে খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক প্রবাহিত করা হয়েছে।
মিলারের এই মন্তব্যে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার পেছনে মাদক পাচারই প্রধান কারণ- ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও আন্তর্জাতিক আইনের ‘প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়ী সার্বভৌমত্ব’ নীতিমালা অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল দেশটির নিজস্ব সম্পদ।
ভেনেজুয়েলা ১৯৭৬ সালে তাদের তেল খাত জাতীয়করণ করে ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পিডিভিএসএর অধীনে আনে। পরে ২০০৭ সালে তৎকালীন বামপন্থি প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ বাকি বিদেশি তেল প্রকল্পগুলোও জাতীয়করণ করেন। এর ফলে কনোকোফিলিপস ও এক্সন মোবিলের মতো মার্কিন তেল জায়ান্টরা কার্যত দেশটি থেকে বিতাড়িত হয়।
এই জাতীয়করণের বিরুদ্ধে মার্কিন কোম্পানিগুলো আইনি লড়াই শুরু করে। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সালিসি ট্রাইব্যুনাল এক্সন মোবিলকে ১৬০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে ভেনেজুয়েলাকে নির্দেশ দেয়। এ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র পিডিভিএসএর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দ্বিতীয় মেয়াদে জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে তাঁর তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি আরও জোরদার করেছেন।
মঙ্গলবার রাতে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর ওপর অবরোধের ঘোষণা দেন এবং সেগুলোকে ‘নিষেধাজ্ঞাভুক্ত’ বলে অভিহিত করেন। ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি মিলারের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ভেনেজুয়েলাবাসী যুক্তরাষ্ট্রের তেল ‘চুরি’ করেছে।
ট্রাম্প লেখেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌবহর দিয়ে ভেনেজুয়েলাকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলা হয়েছে। যতক্ষণ না তারা আমাদের কাছ থেকে আগে চুরি করা সব তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, ততক্ষণে এই বহর আরও বড় হবে ও তাদের জন্য এমন এক ধাক্কা আসবে, যা তারা আগে কখনো দেখেনি।
এই অবরোধ ভেনেজুয়েলার বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক নীতিরই অংশ। মাদুরো প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের সরকারের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে একটি তেল ট্যাংকার জব্দ করে, যাকে কারাকাস ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলার আশপাশে যেসব নৌযানে মাদক বহনের অভিযোগ তুলেছে, সেগুলোর ওপর বোমা হামলাও চালিয়ে আসছে। বহু আইন বিশেষজ্ঞ এই অভিযানকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন।
মঙ্গলবার ভ্যানিটি ফেয়ারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ সুজি ওয়াইলসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, এসব নৌ হামলার লক্ষ্য হলো ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরানো। ওয়াইলস নাকি বলেছেন, মাদুরো ‘আত্মসমর্পণ’ না করা পর্যন্ত নৌকাগুলো ধ্বংস করা চালিয়ে যেতে চান ট্রাম্প।
নভেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন ‘কার্টেল দে লস সোলেস’কে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করে, যদিও এটি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠীর নাম নয়; বরং ভেনেজুয়েলার সরকার ও সেনাবাহিনীর ভেতরের কথিত দুর্নীতির একটি উল্লেখমাত্র। তবে মাদুরো কোনো মাদকচক্রের নেতা বা ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রগামী মাদকের প্রধান উৎস- এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
তবু মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ চুরি’র অভিযোগে তিনি ‘ভেনেজুয়েলার সরকারকে’ বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেবেন।
এদিকে, ধারণা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের মজুত রয়েছে ভেনেজুয়েলায়। আর এটিই এই বিরোধের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) পলিটিকোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অজ্ঞাত সূত্রের বরাতে বলা হয়, মাদুরো ক্ষমতাচ্যুত হলে ভেনেজুয়েলায় ফিরে আসতে আগ্রহী কি না, তা জানতে ট্রাম্প প্রশাসন বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
এক সূত্র পলিটিকোকে বলেন, ভেনেজুয়েলায় ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে শিল্পখাতের সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা হয়েছে। তবে কম তেলের দাম ও বিশ্বের অন্য জায়গায় বেশি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র থাকায় শিল্পখাতে খুব একটা আগ্রহ নেই।
তবে ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেত্রী মারিয়া করিনা মাচাদো ঘোষণা দিয়েছেন, মাদুরো ক্ষমতা হারালে তিনি দেশের তেল খাত বেসরকারিকরণ করবেন ও বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করবেন। চলতি বছর মাচাদো শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন।
সূত্র: আল-জাজিরা
এসএএইচ