ভবিষ্যতের অফিসগুলো কেমন হবে?
করোনা মহামারিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে হোম অফিস। এই মহামারির অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও এই সময়ের মধ্যেই আমরা এটা শিখেছি যে, অফিসের বাইরে, বাড়িতে বসেও কাজ করা সম্ভব। ফলে বর্তমান এই মহামারিতে নতুন করে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, ভবিষ্যত অফিসগুলো কেমন হবে?
অফিস বলতে এমন একটি স্থানকে বোঝায় যেখানে কর্মীরা উপস্থিত থাকতে বাধ্য। সেখানে মিটিং হয় ব্যক্তিগতভাবে বা কোনো হল রুমে। এক্ষেত্রে ডেস্ক বড় পরিসরে জায়গা দখল করে আছে। মহামারিতে অফিস থেকে দূরে অবস্থান করে কাজ করা এবং প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। সে কারণে অফিসের প্রয়োজনীয়তা আসলে কেন সেই প্রশ্ন আসতেই পারে।
অতীতে অফিস ছিল কর্মীদের দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করিয়ে নেওয়ার জায়গা। এখনকার সময়ে অফিস সংক্রান্ত আরেকটি ধারণা হলো লোকসমাগমের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ। অনেকে মনে করেন অফিস মানে এমন একটি জায়গা যেখানে কাজ করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো কর্মীদের একত্রিত করে কাজ করানো, যে কাজগুলো দূরে বসে করা সম্ভব নয়। এছাড়া সম্পর্ক জোরালো করা বা সহযোগিতামূলক ভাব তৈরির মাধ্যমে কোনো প্রজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও অফিসের কাজ। অনেকে অফিসকে একটা দূরত্বের নিরিখেও ব্যাখ্যা করেন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে যেখানে পৌঁছাতে সবাই ছুটতে থাকেন অনেকের কাছে সেটাই অফিস।
অন্যভাবে বলা যায়, অফিস হলো প্রতিদিন একই ডেস্কে একই সহকর্মীদের পাশাপাশি বসা। ২০১৯ এর আগে এটাই ছিল স্বাভাবিক। যোগাযোগের জন্য লোকজনের যাওয়া-আসা, ব্যক্তি বিশেষে ডেস্কে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থাকাটাই অফিসের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতপক্ষে অফিস হচ্ছে, একসঙ্গে বসে টিমওয়ার্ক করা, সম্প্রীতিবোধ আদানপ্রদানের ক্ষেত্র। অনেক ক্ষেত্রে কাজের বাইরে ব্যক্তি অধিকার চর্চাও হয় এখানে।
অফিসে বিভিন্ন টিমের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটি কৌশলগত দিক হলো প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের কাজকে দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপন করা। ফলে যে সকল সহকর্মীর সঙ্গে জুমেও দেখা হওয়ার সুযোগ নেই, তাদের কাজগুলোকে দেখার সুযোগ থাকে। অন্য আরেকটি কৌশল হলো মাঝে মধ্যে একসঙ্গে মিলিত হওয়া। এই ধরনের আয়োজনগুলো সামাজিকতা রক্ষার সুযোগ করে দেয়।
প্রত্যেক অফিসে একে অপরের সঙ্গে কথোপকথনের জন্য, সামাজিকতা রক্ষার জন্য বা এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার জন্য জায়গা থাকে। দেশের বাইরের অফিসগুলোতে বারও থাকে। ডিজাইন এবং আর্কিটেকচার ফার্ম জেন্সলারের পরিচালক রবিন ক্ল্যার এভিয়া জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনকার চাহিদা হলো একটি বড় অডিটোরিয়ামের ব্যবস্থা রাখা, যেখানে ক্লায়েন্টদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকে।
করোনা পরবর্তী সময়ে অফিসের সাজসজ্জাগুলো বহুমাত্রিক কাজের জন্য উপযোগী হওয়া আবশ্যক। অফিসের নানাধরনের আলোচনা তথা ব্যক্তিক অংশগ্রহণ ভার্চুয়ালি করার সুযোগ রাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ক্যামেরা, স্ত্রীন এবং মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। জেন্সলারের নিউইয়র্কের অফিসে একটি ছোট মিটিং রুম রয়েছে। সেখানে চার-পাঁচজন নিজেদের দিকে মুখ না করে স্ক্রিনের দিকে মুখ করে অনায়াসে বসতে পারে।
বৈচিত্র্য থাকা এখনকার অফিসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লোকজন সকালে গ্রুপে আলোচনা করার পরিকল্পনা করতে পারে। তবে বিকেলে অন্য কোনো কাজে সময় দেওয়া প্রয়োজন। হারম্যান মিলার নামে একটি আসবাবপত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান রায়ান এন্ডারসন করোনা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অফিস ব্যবস্থার সাদৃশ্য তুলে ধরে বলেন একটি হলো হোটেল এবং আরেকটি হলো বাড়ি। হোটেলগুলো লোকজনকে বড় জায়গা করে দেয়। এদিক থেকে বাড়ি হলো পরিবারের জন্য এমন জায়গা যেখানে বছরের পর বছর সবাই একসঙ্গে থাকে, নানাধরনের কাজকর্ম করে। আসলে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।
ল্যাপটপ ডকিং স্টেশন বর্তমানে একটি সহজ সংযোজন। তবে এর বাইরে অফিসের নানা ধরনের আসবাবপত্র মেরামত করা বেশ কঠিন। ডেস্কগুলো মেঝের সঙ্গে তার ও প্লাগের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। ভবিষ্যতে মিটিং রুমগুলো আরও বেশি পরিবর্তনশীল হয়ে উঠবে। বিশেষ করে দেয়ালগুলো উঠানো কিংবা ডানে বায়ে সরানো যাবে।
করোনা পরবর্তী সময়ে অফিসগুলোর আরেকটি প্রধান বিষয় হলো তথ্য। সুযোগ-সুবিধা কী পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে, অফিসকর্মীরা কোন দিন কোন সময়ে প্রবেশ করছে প্রোপার্টি ও এইচআর ব্যবস্থাপকরা এ সংক্রান্ত তথ্য অধিক পরিমাণে চাইছে। কর্মীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যেমন- মিটিং কক্ষের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা অথবা কোনো সহকর্মীর করোনার সর্বশেষ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলো তা জানতে চায়।
অফিসগুলোতে ডেস্কে সেন্সর ব্যবহার ও আলো জ্বলে ওঠা, ডেস্ক-বুকিং টুল ব্যবহার ও ভিজিটর ম্যানেজমেন্ট অ্যাপের মাধ্যমে তাৎক্ষনিকভাবে তথ্য প্রদান করে। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠে আসে যে, অফিসের কর্মীদের এই নানাবিধ তথ্য কাদের অধিকারে থাকে এবং অফিসের বিষয়গুলোকে দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে যে তথ্য প্রয়োজন সেগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি লাভের পদ্ধতি কী হবে।
আমরা আশাবাদী হয়ে উঠলে দেখব ভবিষ্যতের অফিস আরো বড়, সহযোগিতামূলক পরিবেশ থাকবে। আর অফিস থেকে বাড়ির দূরত্ব বজায় থাকবে। আর হতাশ হলে দেখব, এটা মূলত সর্বদা নজরদারির, অকেজো মানুষের জায়গায় পরিণত হবে। বাস্তবসম্মত বিবেচনার ভিত্তিতে বলা যায়, অফিস ইজারার ক্ষেত্রে যত সময়ই থাকুক না কেন দালানের সাজসজ্জাকে মহামারির অনিশ্চয়তা আরো পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। যেমনই হোক না কেন, অফিসগুলো আর আগের মতো হয়ে উঠবে না।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
খায়রুন নাহার/টিটিএন/এএসএম