ট্রাইব্যুনালে আবেগঘন পরিবেশ

‘এক চোখ নষ্ট খোকনের, অন্যটিও কাজ করে না-বের হয় না পানি’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪০ পিএম, ০৩ আগস্ট ২০২৫
পুলিশের চরম নির্মমতার শিকার খোকন চন্দ্র বর্মণ/ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। এদিন খোকনের পরিণতি দেখে ও তার কথা শুনে ট্রাইব্যুনালে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়, চোখে পানি চলে আসে অনেকের।

রোববার (৩ আগস্ট) দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে দ্বিতীয়বারের মতো এজলাসে ওঠেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। তখন সাক্ষ্যগ্রহণ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনি ব্যাখ্যা পড়ে শোনান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম। পরে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। প্রথমে জানতে চাওয়া হয় সাক্ষীর পেশা ও নাম-ঠিকানা। তখন প্রসিকিউশন থেকে অনুরোধ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলা হয়, সাক্ষীর নাম ও পেশা বলা হলেও তার ঠিকানা পরে লেখা হবে।

এ সময় চিফ প্রসিকিউটর জানান, সাংবাদিকরা সাক্ষীর বক্তব্য লিখে নেবেন কিন্তু কেউ রেকর্ড করবেন না। এরপর ১২টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণের (২৩) জবানবন্দি। প্রথমে সাক্ষী কাঠগড়ায় বসে বলা শুরু করেন। তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয় দাঁড়িয়ে কথা বলতে কোনো সমস্যা আছে কি না, তখন তিনি দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেন। ২০২৪ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা প্রথম মামলার প্রথম সাক্ষী তিনি।

জবানবন্দি শুরু হওয়ার পর খোকন চন্দ্র বর্মণের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কিছু কিছু বিষয় কয়েকবার উচ্চারণ করার পরও তার কথা স্পষ্ট বুঝতে সমস্যা হয়। তখন আদালত জানতে চান, কথা এমন হচ্ছে কেন। এরপর মুখ থেকে মাস্ক খোলেন খোকন। তার একটি চোখ নেই, নাক নেই, মুখের নিচের অংশ নেই। এ সময় আদালতে উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হয়ে পড়েন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই চুপ হয়ে যান। যদিও রাশিয়া থেকে গত এপ্রিল তার বিকৃত চোয়ালের কিছু অংশে প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি করে আনা হয়েছে। এই আগস্ট মাসে আবারও তার রাশিয়া যাওয়ার কথা রয়েছে।

খোকনের জবানবন্দির শেষদিকে তার মুখের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী তা দেখাতে অর্থাৎ গত বছরের জুলাই-আগস্টে হতাহতদের ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন করা হয় এবং হাজার হাজার হত্যার বিচার চেয়ে তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত কারও কারও চোখের কোণ গড়িয়ে পানি পড়ছিল। এ সময় কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। স্থির থাকতে পারেননি খোদ আসামিও। মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে এজলাস কক্ষ। তখন কারও মুখে কোনো কথা ছিল না। চোখের সামনেই যেন ফুটে ওঠে বাস্তব চিত্র। কিন্তু সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ তখনো দৃঢ় মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় এজলাসে কেউ কেউ বলাবলি করছিলেন সাক্ষী খোকনও এসব দেখে কেঁদে ফেলেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই পাশ থেকে কেউ বলেন, না তার চোখ দিয়ে পানি বের হয় না, কারণ একটি চোখ নষ্ট অন্যটিও কম কাজ করে। বক্তব্যের শেষদিকে খোকন বলেন, আমার এক চোখ নষ্ট। এজন্য তিনি আসামিদের দায়ী করেন।

এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় এজলাসে ওঠেন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্যের শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। এরপর সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

সূচনা বক্তব্যের প্রায় শেষপর্যায়ে দুটি ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শন করা হয়, যা ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত-আহতদের দৃশ্য। এ সময় ভিডিও দেখে এজলাসে থাকা আইনজীবীদের চোখে পানি টলমল করতে দেখা যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার চোখের কোণেও ছিল পানি। এমনকি ভিডিও দেখে পুলিশ সদস্যরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

এদিন সকালে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তায় এ মামলার রাজসাক্ষী হিসেবে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। কিন্তু অন্যদিনের মতো আজ তার হাতে হাতকড়া কিংবা মাথায় হেলমেট পরানো হয়নি। ট্রাইব্যুনালে আনার পর প্রথমে হাজতখানায় রাখা হয়। সেখানে দীর্ঘক্ষণ একাই ছিলেন। বেলা ১১টার পর তোলা হয় কাঠগড়ায়। এরপর বিচারকাজ শুরু হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রথমদিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সোমবার (৪ আগস্ট) অনুষ্ঠিত হবে। ট্রাইব্যুনালে আজ সাক্ষী দেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহত খোকন চন্দ্র বর্মন। তিনি চব্বিশের ১৮ জুলাই থেকে পুরো আন্দোলনের ঘটনা তুলে ধরেন। পরে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে সরকারি খরচে নিয়োগ পাওয়া আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে আরও ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, মিজানুল ইসলাম, মইনুল করিম, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্যরা। এদিকে, জুলাই গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ প্রথম কোনো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সকাল থেকেই বাড়তি নজরদারি বাড়ান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন।

এফএইচ/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।