পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আজ
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর অংশ বিশেষ বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের ওপর চতুর্থ দিনের মতো শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে আজ।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য আজকের দিন নির্ধারিত রয়েছে।
পদ্ধতিগত ত্রুটি, বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যের কারণে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটাই বাতিল হওয়া উচিত বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। তবে বিকল্প হিসেবে তিনি বলেছেন, সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশোধনীর কিছু বিধান সুরক্ষার জন্য মার্জনাও করতে পারেন।
পঞ্চদশ সংশোধনীর অংশ বিশেষ অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তির পক্ষে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী রোববারের শুনানিতে এই আরজি তুলে ধরেন। পরে আপিল বিভাগ শুনানি গ্রহণ করেন। আজ শুনানির পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে।
আদালতে বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কারিশমা জাহান ও বিদুয়ানুল করিম।
এর আগে আপিলের ওপর গত ৩ ডিসেম্বর শুনানি শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল রোববার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সেটি শুনানির জন্য রয়েছে।
এর আগে, পৃথক দুটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর পঞ্চদশ সংশোধনীর অংশবিশেষ অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
তারও ১৪ বছর আগে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরার পথ খুললেও কিছু জটিলতা থেকে যাচ্ছে, এই যুক্তিতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি আপিল আবেদন করা হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদকসহ চার ব্যক্তি একটি আপিল করেছেন। নওগাঁর বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও আরো একটি পৃথক আপিল আবেদন করা হয়েছে।
আপিল তিনটি শুনানির জন্য এদিন আদালতের কার্যতালিকায় ওঠলে সুজন সম্পাদকসহ চার ব্যক্তির পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কারিশমা জাহান ও বিদুয়ানুল করিম। শুনানিতে হাইকোর্টের রায় ও পঞ্চদশ সংশোধনীর দিকগুলো তুলে ধরেন শরীফ ভূঁইয়া। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনে ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ ওই সংশোধনীতে সংবিধানে ৫৪টি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরো আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে গত বছর হাইকোর্টে আলাদা দুটি রিট আবেদন হয়।
সুজন সম্পাদকসহ পাঁচ ব্যক্তি একটি এবং নওগাঁর বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই দুটিসহ পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ ক, ৭ খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
রায়ে গণভোটের বিধানসংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ (দ্বাদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে আনা) পুনর্বহাল করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন সম্পূর্ণ বাতিল না করে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আইন অনুসারে পরবর্তী সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
চলতি বছরের ৮ জুলাই হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পঞ্চদশ সংশোধনী আইন সম্পূর্ণ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ চার ব্যক্তি। অন্য তিন ব্যক্তি হলেন এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। নওগাঁর বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি লিভ টু আপিল করেন।
এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অপর একটি লিভ টু আপিল করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আপিলের রায় হলে কী হতে পারে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ গত ১৩ নভেম্বর লিভ টু আপিল মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় পৃথক তিনটি আপিল হয়, যার ওপর বুধবার শুনানি শুরু হলো।
আপিলে ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী। এ ছাড়া ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কার্য নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস এবং সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠনও ইন্টারভেনার হয়েছে।
২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম