করোনার কিট ক্রয়ের দুর্নীতি তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে রিট
করোনা পরীক্ষার কিট ক্রয়ে সাজানো দরপত্র বাতিল, ক্রয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করতে কমিটি গঠনের জন্য নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে।
জনস্বার্থে মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় মানবাধিকার সংগঠন ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাওছার রিট করেন।
রিটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি), আইইডিসিআর-এর পরিচালক, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক, চীনের সানসিউর বায়োটেক কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে। রিট আবেদন করার বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট জনস্বার্থে ই-মেইলযোগে সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের পরে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় রিট আবেদন করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী।
রিটে বলা হয়, করোনাকালে বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। শত শত কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। করোনা মোকাবিলায় একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হলো করোনা শনাক্তকরণের মানসম্পন্ন কিটের ব্যবহার।
এসব কিট ক্রয় করার জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রয় করত। কিন্তু ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের পর করোনা শনাক্তকরণের আরটিপিসিআর কিট উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় ক্রয়ের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ঔধাগারধাগার কর্তৃপক্ষ।
বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ২২ আগস্ট ২০২১ সালে তিনটি লটে ১৮০ কোটি টাকার ২০ লাখ কিট কেনার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল করোনা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় সরকার গৃহীত জনকল্যাণমূলক প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে সিন্ডিকেট বাণিজ্যের পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সঠিক মানসম্পন্ন কিট ক্রয় করা হবে। কিন্তু দরপত্রের শর্তের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয়েছে সুলভমূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন কিট ক্রয়ের সম্ভাবনা।
রিট আবেদনে, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের প্রাথমিক গবেষণায় মানসম্মত কিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়মের চিত্রটি প্রতীয়মান হয়েছে।
রিটে উল্লেখ করা হয়, প্রত্যেকটি কিটের বাজারমূল্য মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হলেও শুরুতে প্রতিটি কিট ক্রয় করা হয়েছে তিন হাজার টাকার ওপরে। এভাবে স্বাস্থ্যখাতের একটি সিন্ডিকেট এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে লুটপাট করেছে।
বর্তমানে চীনের সানসিউর বায়োটেক নামের একটি কোম্পানি উৎপাদিত ও সরবরাহ করা আরটিপিসিআর কিট ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন। সানসিউর বায়োটেক
কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইউজার ম্যানুয়াল থেকে দেখা যায়, এই কিট করোনা রোগী শনাক্তের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। কারণ কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রতি মিলিলিটারে ২০০ কপি আরএনএ ভাইরাস উপস্থিতি থাকলেই কেবল পজিটিভ রিপোর্ট আসবে। কিন্তু প্রতি মিলিলিটারে ২০০ কপি আরএনএ ভাইরাস না থাকলে করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে।
রিটে আরও বলা হয়, অথচ এমনও কিট কোম্পানি রয়েছে যাদের কিট কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রতি মিলিলিটারে ১০০ কপি আরএনএ ভাইরাস উপস্থিত থাকলেই করোনা শনাক্ত করতে পারবে। সানসিউর কোম্পানির ইউজার ম্যানুয়াল অনুযায়ী তাদের উৎপাদিত কিট শতভাগ করোনা শনাক্ত করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের আইইডিসিআর সানসিউর কোম্পানির উৎপাদিত টেস্ট কিটকে শতভাগ শনাক্তের সার্টিফিকেট দিয়েছে, যা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করে ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন।
রিটে বলা হয়, অনেকে করোনা হওয়া সত্ত্বেও কিটের দুর্বলতার কারণে রিপোর্টে ভুলভাবে নেগেটিভ ফলাফল এসেছে। কাজেই নেগেটিভ ফলাফল আসার কারণে তিনি আক্রান্ত হলেও জানতে পারেননি এবং তার নিজ পরিবার ও অসংখ্য মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে। এভাবে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকহারে বেড়েছে।
অন্যদিকে দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক বিদেশগামী মানুষ করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বিদেশে গমন করার পরে সংশ্লিষ্ট দেশে উন্নতমানের কিট ব্যবহার করে যখন পরীক্ষা করা হয়েছে তখন তাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ফলে করোনা শনাক্তকরণে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও সচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে এবং দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সঠিক গুণগত মানসম্পন্ন কিট ব্যবহার করে করোনা শনাক্ত করা গেলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি আরও বেশি উজ্জ্বল হতো।
মেডিকেল সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্রের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সনদদানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও স্বনামধন্য সংস্থা হলো যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ। এফডিএ অনুমোদিত ও সনদপ্রাপ্ত অনেক করোনা টেস্ট কিট থাকা সত্ত্বেও অনেক মানসম্পন্ন কিট ব্যবহারে আইইডিসিআর অনুমোদন দেয়নি। গুটিকয়েক অখ্যাত কোম্পানির টেস্ট কিট আইইডিসিআর অনুমোদিত হলেও সানসিউর বায়োটেক কোম্পানির কিট ছাড়া অন্য কোনো কিট সরবরাহের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
দরপত্রের শর্তে বিগত এক বছরে বাংলাদেশে এ ধরনের কিট সরবরাহের সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে যে অভিজ্ঞতা কেবল সানসিউর কোম্পানিরই রয়েছে। ফলে ২০ লাখ আরটিপিসিআর কিট ক্রয়ের দরপত্রে সান সিউর বায়োটেক ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির কিট সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই।
একটি সিন্ডিকেটকে দরপত্র পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে শর্তাবলীতে অযাচিত সংশোধনী এনে কিটের বিশুদ্ধতার সমর্থনে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সনদপত্র প্রদানের শর্ত বিলোপ করা হয়েছে, যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর ৪৯ বিধির চরম লঙ্ঘন।
এসব অনিয়ম তুলে ধরে জনস্বার্থে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার প্রকাশিত দরপত্র বাতিল ও এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
এফএইচ/এমআরএম/এমকেএইচ