এমপি আনারের ‘হত্যা’ প্রমাণ না হলে মামলার ভবিষ্যৎ কী?

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩০ এএম, ৩০ মে ২০২৪

এখনো রহস্যের পর রহস্যে ঘেরা ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ড। অভিযুক্তদের বক্তব্য, উদ্ধার আলামত হত্যার বিষয়টি প্রমাণ করলেও আইনের চোখে এখনো তা প্রমাণিত নয়। ফলে এমপি আনার হত্যার ঘটনায় করা মামলা নথিভুক্ত হয় অপহরণ মামলা হিসেবে।

যদিও মামলার তদন্ত সংস্থা ধারণা করছে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে হত্যা করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই মামলায় হত্যা মামলার ধারা ৩০২ সংযোজন করতে আবেদন করবেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে হত্যা প্রমাণ না হলে এটি থাকবে অপহরণ মামলা, যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

গত ২২ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মামলাটি করা হয় দণ্ডবিধির ৩৬৪/৩৪ ধারায়। মামলার বিষয়ে ওইদিন শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আহাদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। সবাইকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

সঞ্জীবা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক ভেঙে সেখান থেকে তিন-চার কেজি মাংসের টুকরো উদ্ধার করেছে কলকাতা পুলিশ। এসব মাংস ফরেনসিক টেস্টের জন্য রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ডিএনএ টেস্টও করা হবে। তারপরে বলা যাবে এগুলো সংসদ সদস্য আনারের কি না।

মামলার পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান। গ্রেফতাররা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এমনকি মরদেহের খোঁজ যেন না মেলে সেজন্য গ্রেফতাররা একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

হত্যার ঘটনা তদন্তে এবং ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারে কলকাতা গেছে ডিবির তিন সদস্যের একটি দল। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে কলকাতায় সাংবাদিকদের ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সঞ্জীবা গার্ডেনসের (যে ভবনে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়) সেপটিক ট্যাংক ভেঙে সেখান থেকে তিন-চার কেজি মাংসের টুকরো উদ্ধার করেছে কলকাতা পুলিশ। এসব মাংস ফরেনসিক টেস্টের জন্য রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ডিএনএ টেস্টও করা হবে। তারপরে বলা যাবে এগুলো সংসদ সদস্য আনারের কি না।’

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আমরা ধারণা করছি তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতাররা রিমান্ডে আছেন। রিমান্ডে তারা এমপি আনারের খুনের বিষয়ে জানিয়েছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কলকাতায় পাঠাচ্ছি। এমপি আনারের মরদেহ মিললে বা তাকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ হলে এ মামলায় হত্যা মামলার ধারা সংযোজনে আদালতে আবেদন করবো। অনুমান বা ধারণার ওপর আমরা হত্যা মামলা বা হত্যা মামলার ধারা সংযোজন করতে পারি না।’

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুস সাত্তার দুলাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আনারের হত্যার অভিযোগ প্রমাণ হলে এ মামলায় হত্যা মামলার ধারা সংযোজন করা যাবে।’

কোন ধারার মামলায় কী শাস্তি
হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন
দণ্ডবিধির ৩৬৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে খুন করতে অপহরণ করেন বা তার খুন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

খুনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড
দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি খুনের অপরাধ করেন তবে তিনি মৃত্যুদণ্ডে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া তিনি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কয়েকজন মিলে একই উদ্দেশ্যে কোনো অপরাধ করলে
দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, যখন কয়েকজন একত্রিত হয়ে একই উদ্দেশ্যে কোনো অপরাধ করেন, তখন ওই অপরাধে অভিযুক্ত সবাই একইভাবে দায়ী হবেন।

ঢাকা জজ কোর্টের ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞ ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে খুনের মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অপহরণ মামলার পর যদি কোনো ব্যক্তি খুন হয়েছেন প্রমাণিত হয় তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা খুনের মামলার ধারা সংযোজনের জন্য আবেদন করতে পারেন। আদালতের কাছে আবেদন যুক্তিযুক্ত মনে হলে তা মঞ্জুর করেন। অপহরণ করে খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। তবে খুন প্রমাণ হলে অপহরণের ধারা বাদ যাবে। কারণ মরদেহ পাওয়া না গেলে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলা হয়। তবে মরদেহ পাওয়া গেলে অপহরণ মামলা আর থাকে না, তখন হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।’

রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন তিন আসামি
এমপি আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামি এখন আটদিনের রিমান্ডে। তারা হলেন- সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান। গত শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আসামিরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন। আমরা তথ্যগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কলকাতা পুলিশকে পাঠাচ্ছি।’

আরও পড়ুন

গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামের এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই তিনি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ।

খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে খুনের মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অপহরণ মামলার পর যদি কোনো ব্যক্তি খুন হন প্রমাণিত হয় তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা খুনের মামলার ধারা সংযোজনের জন্য আবেদন করতে পারেন।

বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচদিন পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম আনার নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলেনি। পরে ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামের একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর কক্ষে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ।

এ ঘটনায় ওইদিনই (২২ মে) ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

মামলার এজাহারে ডরিন উল্লেখ করেন, ‘৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ১১ মে বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে বাবার সঙ্গে মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে বন্ধ পাই।’

১৩ মে আমার বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল- ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত শাহের কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন দেবো।’

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করি। কোনো সন্ধান না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস কলকাতার বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। বাবাকে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে বাবাকে অপহরণ করেছে। বাবাকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি।

এছাড়া আরও কয়েকটি মেসেজ আসে। মেসেজগুলো তার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে বলে এজাহারে উল্লেখ করেন মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

জেএ/কেএসআর/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।