পরিবার দিবস
পরিবারই পারে মাদকাসক্তি থেকে সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে

মাদকাসক্তি এক ভয়ংকর নেশা। এ নেশা শুধু একজন ব্যক্তিকে নয় বরং নিঃশেষ করে দেয় একটি পরিবারকে। ধ্বংস করে দেয় পরিবারের ভালোবাসা, সম্পর্ক আর স্বপ্নের ভিত।
সন্তানের চোখে যে ভবিষ্যৎ দেখেছিল মা-বাবা, মাদকাসক্তির কারণে সেই চোখে এক সময় ঘন হয়ে নামে অন্ধকার। শোনা যায় পরিবারের বুকভরা দীর্ঘশ্বাস। তবে এই মুহুর্তেও অন্ধকারে আলো ফেরানো যায়, যদি পরিবার হাল না ছাড়ে।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তির প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ২০২৫ সালে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষ মাদকাসক্ত, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী কিশোর ও তরুণ।
এই বয়সী তরুণরা ভুল বন্ধুদের চাপ, পারিবারিক অবহেলা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, কিংবা স্রেফ কৌতূহল বা হিরোইজমের কারণে মাদকের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু একবার মাদকে আসক্ত হয়ে গেলে তার ফেরার পথ কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার।
সন্তান বা পরিবারের সদস্য মাদকাসক্ত হলে প্রথম করণীয় হলো তাকে দোষারোপ না করে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা, অনুসন্ধান করা। তার আচরণ, মানসিক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করা। অনেক পরিবারই এই পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয়, তাদের সঙ্গে খারাপ আচার-আচরণ করে এমন কি মারধর করে বাসা থেকে বেরও করে দেয়, এটি একটি অনেক বড় ভুল।
মাদকাসক্ত সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হয় নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে সে নিজের ভেতরের যন্ত্রণার কথা খুলে বলতে পারবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত হবে তার পাশে দাঁড়ানো। এমন কি দোষারোপ না করে, বরং তাদের সঙ্গে ভালোবাসা দিয়ে কথা বলা। প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় তার সঙ্গে কাটানো, তার পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে চেষ্টা করা।
তবে অনেক সময় অতি ভালোবাসার কারণে আসক্তি থেকে ফেরাতে কেবল পরিবার আর যথেষ্ট হয় না। এ অবস্থায় প্রয়োজন হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কাউন্সেলর কিংবা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সহায়তা।
পরিবারকে বুঝতে হবে, মাদকাসক্তি একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা, চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হয়। কোনো লজ্জা বা সামাজিক চাপ, যেমন লোকে কি বলবে, এসব কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে পেশাদার সহযোগিতা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫৪টির বেশি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে, যারা বিভিন্নভাবে মাদকাসক্তি নিরাময় বা এর প্রভাব কমাতে কাজ করছে।
অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা না বুঝেই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে সন্তানের মধ্যে অবসাদ ও হতাশা তৈরি হয়। তাই সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি পরিবারকেও নিজেদের আচরণ, পরিবেশ ও কথাবার্তা নিয়ে সতর্ক হতে হবে। বাড়িতে বন্ধুত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ আবহ তৈরি করা জরুরি। প্রয়োজনে পরিবারকেও কাউন্সেলিং নিতে হবে।
মাদকাসক্তি থেকে ফেরার পথ সহজ নয়। উন্নতি করতে করতেও সন্তান বিপথে ফিরে যেতে পারে। তবে পরিবারকে এ সময় ধৈর্য হারানো চলবে না। পরিবারকে চেষ্টা করতে হবে, একবার নয়, দশবার চেষ্টা করতে হতে পারে। সন্তানকে সব সময় পজেটিভ বার্তা দিতে হবে। সন্তানের সামনে এমন বার্তা দিতে হবে যেন তারা আশাবাদী হয়, যেমন - ‘তুমি ভুল করলেও আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব না, তোমার পাশে আছি।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবারই মাদকাসক্তি নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি। মনোরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিরত ডা. মালিহা তাবাসসুম বলেন, ‘পরিবারের সহানুভূতি ও সমর্থন ছাড়া মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই পরিবারের কোনো সদস্যকে মাদকাসক্তি থেকে ফেরাতে চাইলে প্রয়োজন পরিবারের ভালোবাসা ও ভালো ব্যবহার।’
মনে রাখতে হবে, সন্তান যখন বিপথে যায়, তখন পরিবারই তার প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। অন্ধকারের এই পথ থেকে আলোর দিকে ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে বড় শক্তি পরিবারের ভালোবাসা, ধৈর্য আর সচেতনতা।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি, সন্তান মাদকাসক্তিতে ডুবে গেলেও তার হৃদয়ের কোথাও না কোথাও পরিবারের জন্য ভালোবাসা থেকেই যায়। সেই ভালোবাসার সেতু ধরেই তাকে ফেরানো সম্ভব।
এএমপি/এএসএম