ফকির ইলিয়াস: কবিতার আধুনিক কারিগর

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৯ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২

মুহিত চৌধুরী

যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ফকির ইলিয়াস একজন কবি, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধগবেষক, সব্যসাচি লেখক। বাউল এবং মরমিধারার গীতিকবিতা দিয়ে লেখালেখির জগতে তার অভিষেক হলেও পরে তিনি অতি আধুনিক কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আশির দশকে প্রকাশ হয় ‘বাউলের আর্তনাদ’ নামক গীতিকাব্য।

ইংরেজি সাহিত্যে গীতিকবিতাকে লিরিক পোয়েট্রি বলা হয়। তার কারণ লায়ার নামক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এ শ্রেণির কবিতা গীত আকারে পরিবেশিত হতো। তেমনি ফকির ইলিয়াসের অনেক আধুনিক গীতিকবিতা একতারা এবং দোতারা দিয়ে মরমি এবং বাউলশিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়েছে।

কবি ফকির ইলিয়াস আধুনিকতার চরম উৎকর্ষের মধ্যে থেকেও শিকড়চ্যুত হননি। তার আধুনিক কবিতায় সে ধারা এখনও বহমান। এখানে ফকির ইলিয়াসের ‘ডিপোর্টেশন’ কবিতাটি উল্লেখ করা যায়—
নীল পাসপোর্টটি ওরা আমার হাত থেকে
কেড়ে নেয়ার পর বললো—
‘সনদটি কোথায় রেখেছ!’
আমি সেটাও তাদের হাতে তুলে দিতে দিতে
খোলা আকাশের দিকে তাকালাম।

পাখিরা উল্লাস করতে করতে বনে ফিরছে।
একদল মাছশিকারি,
ইস্টরিভারে তাদের হাতের বড়শি
নিক্ষেপ করতে করতে;
তাকিয়ে হাসছে, একে অপরের দিকে!

পশ্চিম থেকে কয়েকটি উড়োজাহাজ,
চক্কর দিচ্ছে আকাশে,
পূর্বের দিকে উড়বে বলে।

এক একটি প্লেনে কয়টি কফিন উড়ে যাচ্ছে আজ!
কতজন স্বপ্নবিক্রেতা, তাদের স্বপ্নের সওদা
শেষ করে আজ ফিরে যাচ্ছেন মাতৃপ্রদেশে!

আমি আমার হাতের রেখার দিকে তাকাই।
দেখি, ভাগ্যরেখাগুলো অনেক আগেই মুছে গেছে
দেশান্তরি গ্রহ নামের সমুদ্রে, আমাকে না জানিয়েই!

নিঃসন্দেহে বলা যায়, কবিতাটি আধ্যাত্মিকতার এক আধুনিক সংস্করণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত এ কবি প্রবাসে থেকেও বুকে বাংলাদেশকে ধারণ করেন নিবিড় ভাবে।

ফকির ইলিয়াস মূলত কবি। প্রাবন্ধিক, গল্পকার, গ্রন্থসমালোচক, সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি—লালন ও চর্চায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

এ যাবৎ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ২৪টি। ২০২৩ সালের বইমেলায় তার আরও ৪টি প্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার’ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস ‘মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার’—গ্রন্থ দুটিতে তিনি দক্ষতার সাথে বর্ণনা করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের চাওয়া-পাওয়া। বাংলার চিরায়ত মরমিধারার সহস্রাধিক গানের পদকর্তা এ কবি।

তার লেখা নিয়মিত ছাপা হচ্ছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক, কানাডা, সুইডেন, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রে। ওয়েব, ব্লগ, ই-নিউজ গ্রুপেও তিনি লিখছেন নিয়মিত।

সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ‘ফোবানা সাহিত্য পুরস্কার’, ‘ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরস্কার’, ‘কবিতাস্বজন প্রীতি সম্মাননা’, ‘মৃত্তিকায় মহাকাল আবৃত্তি উৎসব স্মারক’ পেয়েছেন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘ঘুংঘুর’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। এ ছাড়াও অনেকগুলো ওয়েব পোর্টালের প্রধান সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, উপদেষ্টা সম্পাদক, এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার, কান্ট্রি এডিটরের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।

তিনি ‘দ্য একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস’, ‘দ্য অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’, ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’, ‘আমেরিকান ইমেজ প্রেস’র সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন বহু বছর ধরে।

তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে—বাউলের আর্তনাদ (গান-১৯৮৫), হৃদে গাঁথা মালা (গান-১৯৮৯), এ নীল নির্বাসনে (কবিতা-১৯৯১), অবরুদ্ধ বসন্তের কোরাস (কবিতা-১৯৯৬), দাক্ষিণ্য বিষয়ক দিন (কবিতা-১৯৯৮), বৃত্তের ব্যবচ্ছেদ (কবিতা-২০০১), অনন্ত আত্মার গান (গান-২০০২), কবিতার বিভাসূত্র (প্রবন্ধ-২০০৯), চৈতন্যের চাষকথা (গল্প-২০১০), গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ (কবিতা-২০১১), ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম (কবিতা-২০১২), গৃহীত গ্রাফগদ্য (কবিতা-২০১৪), অনির্বাচিত কবিতা (কবিতা-২০১৫), সাহিত্যের শিল্পঋণ (প্রবন্ধ-২০১৬), মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার (প্রবন্ধ-২০১৭), মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার (উপন্যাস-২০১৭), শহীদ কাদরীর দরবারের দ্যুতি (প্রবন্ধ-২০১৮), প্যারিস সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা (কবিতা-২০১৮), নক্ষত্র বিক্রির রাতে (কবিতা-২০১৯), সম্মোহিত শব্দদাগ (প্রবন্ধ-২০১৯), গ্রহান্ধ ঘরের কাহিনি (কবিতা-২০১৯), ধানমণ্ডির ধ্বনিপুত্র (কবিতা-২০২০), যতিকল্পের প্রতিপৃষ্ঠা (প্রবন্ধ-২০২২) এবং নির্বাচিত সনেট (কবিতা-২০২২)।

সাংবাদিকতার সঙ্গে তার সংযুক্তি প্রায় চার দশকেরও বেশি সময়ের। তিনি বিভিন্ন সময়ে যেসব মিডিয়ায় দায়িত্ব পালন করেছেন এর মাঝে রয়েছে—উত্তর আমেরিকা প্রতিনিধি, দৈনিক আজকের কাগজ, ঢাকা (জানুয়ারি ১৯৯২ থেকে অক্টোবর ২০০৬), যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি, দৈনিক সিলেটের ডাক, সিলেট (জানুয়ারি ১৯৮৯ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮), যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক জনমত, ইংল্যান্ড (জানুয়ারি ১৯৯০ থেকে ডিসেম্বর ২০০৯), যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন, ঢাকা (জানুয়ারি ১৯৯০ থেকে ডিসেম্বর ২০০২), নিউইয়র্ক প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক সময়, ঢাকা (জানুয়ারি ১৯৯৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০১)।

সহধর্মিনী কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি এবং দুই কন্যা নাহিয়ান ইলিয়াস ও নাশরাত ইলিয়াসকে নিয়ে বসবাস করছেন নিউইয়র্কে। জীবনের ৬০ বছর পেরিয়ে ৬১ বছরে পা দিচ্ছেন কবি ফকির ইলিয়াস। এ সময়ের অন্যতম উজ্জ্বল এ কবির ৬০তম জন্মদিন আজ। ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি সিলেটে জন্মগ্রহন করেন। কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

লেখক: কবি, গীতিকার ও সম্পাদক, দৈনিক সিলেট।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।