নজরুলের সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন


প্রকাশিত: ০৬:৪৪ এএম, ২৯ আগস্ট ২০১৬

‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,/সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ ...এভাবেই মন ও প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে সাম্যের বন্দনা গেয়েছেন প্রেম, দ্রোহ ও গণমানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নজরুল ইসলাম জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষকে মানুষ হিসেবেই অঙ্কন করেছেন। সাম্য এবং অসাম্প্রদায়িকতার জন্য আকুতি তাঁকে এক উচ্চমার্গীয় আসনে আসীন করেছে। কিন্তু তাঁর সেই সাম্য কি সমাজে প্রতিষ্ঠিত? যখন দেখি মানুষে মানুষে সাম্প্রদায়িকতার হানাহানি, ধর্মের বিভেদ, ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য, নারী-পুরুষের অসম অবস্থান তখন কি করে বলি নজরুলের সাম্যের গান এ সমাজকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। পুঁজিবাদী সমাজে আজ মনুষ্যত্বই অবহেলিত, সেখানে নজরুলের সাম্যের বন্দনা তুচ্ছ। কবির গীতি আজ কবিতায় আবদ্ধ- বাস্তবে নয়। যার প্রভাব আজ প্রতিনিয়ত লক্ষ্যণীয়। তাঁর সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার আলোয় কেটে যাবে সকল আঁধার।
 
একুশ শতাব্দীতে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম। ধর্মের নামে আজ নৃশংসভাবে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। হত্যার আগে নির্ধারণ করা হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। ধর্মকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। মানুষ, মনুষ্যত্ব আর মানবিকতার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম। ফলে মানুষ ধর্মকে আজ দানবে পরিণত করেছে। যে দানব গ্রাস করছে দেশ, জাতি ও সমাজকে। নজরুল গেয়ে গেছেন অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান। ‘গাহি সাম্যের গান-, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

নজরুলের এই বাণীই আমাদের পথ দেখায়। তিনি যে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি একেঁছেন, তাতে এসমাজ প্রতিফলিত হয় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর আদলে মাপা হচ্ছে মানুষকে। দেশে কোনো কিছু হলেই প্রথম আঘাত আসে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখা হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু।  কবি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ সত্যিই তাঁর সাম্যের দর্শনের কোনো জুড়ি হয় না। তিনি সাম্যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর মন্ত্র এই সমাজ সাধন করলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা কেটে যেত, দেখা মিলত এক অন্য রকমের সমাজ। নজরুলের সেই সাম্য আজ আমাদের হাতছানি দেয়।

ধর্মীয় গোড়ামি এ সমাজে এখনও প্রকট। তা থেকে উত্তরণে পথ দেখান নজরুল। তাঁর মনের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার ও বুদ্ধিবৃত্তি সক্রিয় রেখে, স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ জাগরণ। তিনি চেয়েছিলেন- ‘যেখানে আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে সব ব্যাবধান’ সেখানে এসে মিলিত হয়ে বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করে সকল সংকীর্ণতা, সংশয় চিরতরে পরিহার করে সুন্দরের ধ্যান ও স্তব-গান গেয়ে সকল মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে। আর সে কারণে নজরুল শুধু বিদ্রোহের কবি নন; তিনি মিলনের কবি, হিন্দু-মুসলমানের কবি, সকল মানুষ, সকল ধর্ম ও সকল জাতির কবি। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস কিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ (যুগবাণী) ধর্মীয় বিভেদ দূর করার জন্য নজরুলের যে ধ্যানধারণার প্রকাশ করেছেন, তার জুড়ি হয় না। তিনি বলেছেন, ‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/এক সে আকাশ মায়ের কোলে/যেন রবি শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’ আজ ভারত কিংবা আমাদের বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে যে বিভেদ, তা দূর করার জন্য নজরুলই যথেষ্ট। কবি দেখিয়েছেন মানুষ এবং মানবতাই বড় ধর্ম। কবির ভাষায়, ‘তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার। কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে?’ ধর্ম মানুষের মাঝেই। মানুষ নিজেই বড় ধর্ম।

ধনী-দরিদ্রদের বৈষম্য এ সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। দেশের সমস্ত সম্পদ আজ কিছু মানুষের হাতে জিম্মি। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাজকে কলুষিত করে তুলেছে। সমাজের এক পক্ষ দিনদিন সম্পদের পাহাড়  গড়ছে, আরেক পক্ষ কেবল শোষিত, নির্যাতিত এবং বঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। কিন্তু নজরুল এই সমাজকে চাননি। সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে সত্য ও সুন্দরের সমাজ চেয়েছেন। শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, অবহেলিত সর্বোপরি দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জয়গান তিনি গেয়েছেন সোচ্চারকণ্ঠে। যার কারণেই তিনি হয়ে উঠেছেন সাম্যের কবি, মানবতার কবি। সেই মানবতা আজ বিপন্ন। নজরুল ইসলামের জীবনদর্শন ছিল সাম্যের। মানুষকে তিনি দেখেছেন সবার শীর্ষে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহিয়ান’। তাঁর এই একটি বাণী এ সমাজ মনে-প্রাণে নিতে পারলে কেটে যাবে জঙ্গিবাদের মতো সমস্যাসমূহ।

তাঁর কবিমানসে কোনো নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। তিনি জাতি ও সমাজের জন্য সর্বদা উদগ্রীব ছিলেন। সেই প্রমাণ আমরা পাই কবির এক ভাষণে। নজরুল ইসলাম বললেন, ‘আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল কালের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব-গান সে আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে বর্ণে, যে দেশে যাই, যে দেশে জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।’ নজরুলের জীবনের যৌবনের সময় কেটেছে সাংবাদিকতা অঙ্গনে। সেখানেও উচ্চারিত হয়েছে তার সাম্যের গান। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার জন্য নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল পত্রিকার মাধ্যমে জাতিকে নির্ভীক ও সতেজ ভাষায় জাগরণীর আওয়াজ তুলেছেন তিনি। ‘লাঙল’ পত্রিকায় নজরুল ইসলাম কৃষক, শ্রমিক, নারী, জেলে, প্রভৃতি নির্যাতিত ও শোষিত সমাজকে নতুন পথের ও মতের কথা শুনিয়ে তাদের মাঝে মুক্তির আগ্রহ জন্মাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

নজরুল ইসলামের সাম্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সাক্ষাৎ হবে সত্য ও সুন্দরের। সেই শান্তি এবং কল্যাণের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে উঠুক এই সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র- তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এমনটিই প্রত্যাশা।

এসইউ/এইচআর/আরআইপি

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।