ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

মানবতাবিরোধী অপরাধে আরও ৩ মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে

মুহাম্মদ ফজলুল হক | প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই মামলার আসামি ও পরে রাজসাক্ষী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পাঁচ বছরের লঘুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

জুলাই গণহত্যা মামলায় প্রথম রায়ের পর এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোন মামলার বিচার শেষ হচ্ছে, বিচার শেষ হলেই কি রায় ঘোষণা করা হবে, নাকি অন্য কোনো মামলার রায় ঘোষণা করা হবে? সে রায় কবে ঘোষণা করা হতে পারে তা নিয়ে চলছে নানান আলোচনা।

এবার রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলাটি রায়ের দিকে যাচ্ছে। বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের আনা সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন পর্যায়ে চলে এসেছে।

আরও পড়ুন
কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশদাতা ছিলেন ইনু
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেফতার দেখাতে নির্দেশ
হানিফসহ ৪ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ ৮ ডিসেম্বর
ইনুর আবেদনে জুলাই বিপ্লবকে ‘সো-কল্ড’ বলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা

আইনজীবীদের আশা, গত বছরের ৫ আগস্টের পর পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটিই হতে পারে দ্বিতীয় রায়।

ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য উপস্থাপনের পরই গ্রেফতার থাকা আসামিরা সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষেই মামলাটি বিচারের সর্বশেষ ধাপ, অর্থাৎ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে আসবে। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পরই রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে অন্যতম আলোচিত এ মামলা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছয় আন্দোলনকারী। এ ঘটনায় করা মামলাটিই পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা (আইসিটি বিডি কেস নম্বর ১/২০২৫) হিসেবে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এই মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে হাবিব, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। অন্যদিকে শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। ধার্য দিনে গ্রেফতার আসামিদের নিয়মিত হাজির করা হয় ট্রাইব্যুনালে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলাটির বিচার কাজ চলছে।

এই মামলার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামিপক্ষের তিনজনকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে। মামলাটি একেবারে শেষপর্যায়ে। আসামিপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলেই মামলার সর্বশেষ পর্যায় যুক্তিতর্ক। এরপরে রায়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ করবেন আদালত।’

আরও পড়ুন
গ্রেফতার ২ সেনা কর্মকর্তার ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল হাজিরার আরজি
বিজিবির রেদোয়ানুলসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে শুনানি ৪ ডিসেম্বর
ট্রাইব্যুনাল বললেন, আইন সবার জন্য সমান
জিয়াউল আহসান শত শত মানুষকে পেট কেটে নদীতে ফেলে দিয়েছেন

মামলার বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রসিকিউশনে সাক্ষ্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আসামিদের পক্ষে তিনজনকে সাক্ষী হিসেবে আমরা সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করবো। এরপরই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে যাবে এ মামলাটি। এর পরেই রায়। এই রায়টি হতে পারে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়।’

মামলায় অভিযোগ দাখিলের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। মামলার তদন্ত পর্যায়ে ৭৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। পরে গত ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল এবং বিচার শুরুর আদেশ দেন। তার পর গত ১১ আগস্ট চিফ প্রসিকিউটরের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচার শুরু হয়। একই দিনে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গ্রহণ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. মনিরুল ইসলামসহ এখন পর্যন্ত প্রসিকিউশনের ২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগ অনুযায়ী, গণঅভ্যুত্থানের সময় সারাদেশে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ হিসেবে গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা হলেন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া।

ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত আরও তিনটি মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা, রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা যুবককে গুলি ও হত্যার ঘটনা এবং আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানো এবং একজনকে হত্যার ঘটনা। এর পাশাপাশি জুলাইয়ে প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিচার চলছে। এর মধ্যে তিনটি মামলা কাছাকাছি সময়ে শেষ হতে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, চানখাঁরপুলের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য শেষে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। আর আশুলিয়া ও রামপুরার ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার (আইওর) সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা মামলাটি সবার আগে শেষ হতে পারে। কিন্তু কবে রায় ঘোষণা করা হবে সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আইনজীবীরা। যদি কোনো মামলায় আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী না থাকে তা হলে হয়তো অন্য কোনো মামলা এগিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে রামপুরা বা আশুলিয়ার মামলাটি তালিকায় রয়েছে। এখন দেখার পালা আগে কোন মামলায় রায় ঘোষণা করা হতে পারে।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে করা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। সেই সঙ্গে কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবউল আলম হানিফসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে।

আরও পড়ুন
গুমের ২ মামলায় শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স জেডআই খান পান্না
বিচারক-রায় নিয়ে কটূক্তি ও ছবি সরাতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ
পৃথিবীর যে-কোনো আদালত শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করবে
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে বৈশ্বিক অ্যাম্বাসেডর ও উপদেষ্টা নিয়োগ

অন্যদিকে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে গুমের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ও সেনা কর্মকর্তাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা এবং সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাসহ ২৮ আসামির বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করার অবস্থায় রয়েছে।

এছাড়া গণঅভ্যুত্থানে রামপুরায় ২৮ জনকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার বিজিবির সাবেক দুই কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর মো. রাফাত বিন আলম মুনসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের দিন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

গত ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগ রায়ের সময় পরিমার্জন করে দুটিতে ভাগ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অন্যটিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দুই অভিযোগেই রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে দেওয়া হয় পাঁচ বছর জেল।

রায়ের সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করায় চৌধুরী মামুনের সাজা কমানো হয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, শেখ হাসিনা ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যহারের নির্দেশ দিয়ে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি করেছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ পালন করেন। শেখ হাসিনা তাদের এই নির্দেশ দিয়েছেন।

রায়ে আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলির ‘নির্দেশ’ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল এবং সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোন কথোপকথন তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং পরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারকাজ চলার সময় অডিও, ভিডিওসহ যেসব তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে সেসবও বর্ণনা করেন বিচারক। ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা কী বলেছেন তার বর্ণনা দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন ভিডিওতে পাওয়া শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-প্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয় রায়ে।

এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোর ভিডিও ও তথ্যপ্রমাণের বিবরণও রায়ে দেওয়া হয়েছে।

এফএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

আরও পড়ুন