‘নতুন বাংলাদেশ’ ও তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন
রাজ মাসুদ ফরহাদ
দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের প্রবাস জীবন শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেন নতুন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ করলেন। সম্প্রতি ‘বিবিসি বাংলা’কে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ ধারণার স্পষ্ট রূপরেখা। সেখানে রয়েছে প্রত্যাবর্তনের বার্তা, নির্বাচনের সংকেত এবং পরিবর্তনের আহ্বান—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন পর্বের সূচনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যে দেশের মানুষ নিজের শক্তিতে জাগে, সেই দেশকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না।’ তারেক রহমানের বক্তব্যে এই জাগরণের প্রতিধ্বনি স্পষ্ট—একটি আত্মবিশ্বাসী ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যয়।
প্রত্যাবর্তনের সুর ও জনআশা
দীর্ঘ রাজনৈতিক নীরবতা ভেঙে তারেক রহমান এমন এক সময়ে বক্তব্য রেখেছেন, যখন দেশ অনিশ্চয়তা ও স্থবিরতার ঘূর্ণিপাকে। তার সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে নতুন প্রজন্মের রাজনীতি, জবাবদিহি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা। দেশে ফেরার ঘোষণা যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে, তেমনই জনগণের মধ্যেও আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে—পরিবর্তনের সময় হয়তো আসন্ন।
প্রবাস জীবনের কষ্ট, মা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, ভাই আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু—এই ব্যক্তিগত বেদনাগুলো তিনি অকপটে ভাগ করেছেন। আবেগঘন মুহূর্তে তার চোখে জল কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা—এই দ্বৈত প্রকাশ তাকে রাজনীতির মানবিক দিকের প্রতীক করে তোলে।
কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমি চিরবিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছুঁয়ে দাঁড়াই।’ তারেক রহমানের অবস্থানেও যেন সেই বিদ্রোহী আত্মার প্রতিফলন—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ এবং অন্যরকম বাংলাদেশের স্বপ্ন। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘It always seems impossible until it’s done.’ বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও উদ্ধৃতিটি গভীর অর্থ বহন করে—অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহসী আহ্বান।
‘জুলাই অভ্যুত্থান’ ও নতুন রাজনৈতিক পাঠ
সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’। সেখানে তারেক রহমান নিজেকে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে তুলে ধরেননি বরং তিনি একে দেখেছেন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তির আন্দোলন হিসেবে। এ অবস্থান তাকে দলীয় রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে। তিনি সতর্ক করেছেন—স্বৈরাচারবিরোধী এ গণঅভ্যুত্থানকে যেন কেউ দলীয় অভ্যুত্থান বলে অপপ্রচার না করে। তার ভাষায়, এটি ছিল মুক্তিকামী মানুষের আস্থা ও আশার প্রতিফলন।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘The best way to find yourself is to lose yourself in the service of others.’ জনগণের প্রতি তারেক রহমানের আহ্বানে সেই সেবামূলক রাজনীতির দর্শন প্রতিফলিত—ক্ষমতা নয় বরং মানুষের কল্যাণই রাজনীতির মূল লক্ষ্য। ছাত্র, শ্রমিক, নারী, গৃহিণী, পেশাজীবী—সব শ্রেণিপেশার মানুষকে একত্রিত করে তিনি বিএনপিকে জনআন্দোলনের কেন্দ্রে দাঁড় করানোর বার্তা দিয়েছেন। শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি মানবিক সমবেদনা তার রাজনৈতিক বক্তব্যকে আরও হৃদয়গ্রাহী করেছে।
আরও পড়ুন
জনজীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে মশা
অনন্ত জলিল ও প্রেস সচিবের বিতর্ক, কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন
দলীয় সংস্কার ও জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি
দলীয় দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে তার স্বীকারোক্তি সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জানিয়েছেন—দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এটি বিএনপির অতীত ভাবমূর্তি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। ‘প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী নির্ধারণ করবে জনগণ’—এ ঘোষণা দলীয় উত্তরাধিকারের বিতর্কের অবসান ঘটানোর এক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
জসীম উদ্দীনের পঙ্ক্তিটি যেন তার রাজনৈতিক যাত্রার প্রতিচ্ছবি—‘মানুষের মন যদি জেগে ওঠে, সে আর ঘুমায় না।’ আর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যেমন বলেছিলেন, ‘Faith is taking the first step even when you don’t see the whole staircase.’ তারেক রহমানের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপও যেন সেই বিশ্বাসের প্রথম ধাপ—গণতন্ত্রের অন্ধকারে আলো খোঁজার প্রচেষ্টা।
জোট রাজনীতি ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পরিকল্পনা
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ৬৪টি রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘রাষ্ট্র পুনর্গঠন’র ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এটি কেবল একটি নির্বাচনী কৌশল নয় বরং একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন—সহযোগিতা, অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণ।
জামায়াতে ইসলামীর পৃথক অবস্থান নিয়ে তার উদ্বেগহীনতা প্রমাণ করে তিনি বহুদলীয় প্রতিযোগিতাকে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক রূপ হিসেবেই দেখছেন। এ রাজনৈতিক পরিণতিই তাকে একজন সম্ভাবনাময় নেতৃত্বে রূপ দিয়েছে। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘Success is not final, failure is not fatal: it is the courage to continue that counts.’ তারেক রহমানের রাজনৈতিক পুনরাগমনও সেই সাহসের প্রতীক—ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।
উপসংহার
জুলাই অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা শুধু দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতেরও সূচনা। ‘নতুন বাংলাদেশ’র যে স্বপ্ন তিনি এঁকেছেন, তার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংস্কার, জবাবদিহিতা ও জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের ওপর। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘দেশ প্রেমিকের মর্যাদা কেবল কথায় নয়, কাজে প্রকাশ পায়।’ রাজনীতির প্রকৃত ‘মাস্টারমাইন্ড’ কোনো ব্যক্তি নন—বরং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণই। তারাই ‘নতুন বাংলাদেশ’র প্রকৃত স্থপতি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/জিকেএস