ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্ক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৫ পিএম, ০৮ এপ্রিল ২০২৫
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। একসময় ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) দাপুটে প্রসিকিউটর। ২০১০ সালে গঠিত এ ট্রাইব্যুনালে তিনি প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পান ২০১৩ সালে। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আলোচনায় আসেন এ আইনজীবী।

আলোচিত থেকে বিতর্কিত
২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার তুরিন। তবে আসামির সঙ্গে অনৈতিকভাবে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ওই মামলার বিচারকাজ চলাকালেই ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পরের বছর ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে অপসারণ করে তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তার এ অপসারণ ‘খুব জরুরি ছিল’ বলে জানিয়েছিলেন বর্তমানে কারাগারে থাকা সেসময়কার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ অপসারণের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে তুরিন আফরোজের আইন পেশায় অনেকটাই ছন্দপতন ঘটে।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্কবাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তুরিন আফরোজ

পারিবারিক কেলেঙ্কারি ও নিজের মাকে হেনস্তার অভিযোগ
এরপর হঠাৎই সামনে আসে তার পারিবারিক কেলেঙ্কারি। মিথ্যা মামলা দিয়ে নিজের মাকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে এ আইনজীবীর বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে জন্মদাতা মাকে বাড়ি থেকেও বের করে দেন তিনি। এমনকি নিজের মাকে হেনস্তা ও নির্যাতনের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।

গত বছরের ২৫ নভেম্বর দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের কাছে তুরিনের বিরুদ্ধে হেনস্তা ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন তার মা সামসুন নাহার তসলিম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, উত্তরায় আমার নিজের বাড়িতে আমি থাকতে পারছি না। আমাকে বের করে দিয়েছে। আমি এ বাড়ি ও বাড়ি, ভয়ে ভয়ে থাকি। যেখানেই থাকি সে (তুরিন) খবর পেলেই সেখানে লোকজন পাঠায়।

ওইদিন সামসুন নাহার তসলিম আরও বলেন, ও আগে ভালোই ছিল। কিন্তু আমার বাবা (তুরিনের নানা) মারা যাওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। থানা পুলিশের ভয় দেখায়, আমি তো একা থাকি, আমি বাধ্য হয়েছি এখান থেকে চলে যেতে। শুধু এখানেই নয়, নীলফামারীতে আমার গ্রামের বাড়ি, সেখানেও আমাকে নিষিদ্ধ করেছে। আমি যেন এলাকায় যেতে না পারি সে সন্ত্রাসীর ভয় দেখায়। আমাকে জামায়াতের রোকন বানিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছে। অথচ জামায়াতের সঙ্গে কোনোদিন আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

গ্রেফতারের পর রিমান্ড
একসময়ের সেই দাপুটে আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে গতকাল সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তার বিরাট ভূমিকা ছিল। তুরিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও আছে। আজ মঙ্গলবার পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাইলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্কআদালতে তোলা হচ্ছে তুরিন আফরোজকে

এদিকে, সোমবার রাতে উত্তরার বাসা থেকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে গ্রেফতারের পর রাতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম।

তিনি জানান, পুলিশ অভিযানের সময় তার (তুরিন) ল্যাপটপ ও মোবাইলের ফেসবুক চেক করে অনেকগুলো সরকারবিরোধী প্রচারণা পেয়েছে। তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে একজন ছাত্র হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আব্দুল জব্বার নামের এক ছাত্রকে হত্যার উদ্দেশে গুলিবিদ্ধ করার অভিযোগে দায়ের করা মামলার ৩০ নম্বর আসামি তিনি।

আসামিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

তখনকার সময়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওরফে সাকা চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে আলোচনায় চলে আসেন এ আইনজীবী।

তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রভাবশালী দুই আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ ছিল তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে। এরপরই ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে অনৈতিকভাবে আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠক করার অভিযোগ তদন্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনও করা হয়।

নিজের মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন
রাজধানীর উত্তরার রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনের ১১ নম্বর সড়কের ৩ সেক্টরের ১৫ নম্বর প্লটের পাঁচতলা বাড়িতে ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন তুরিন আফরোজের মা সামসুন নাহার তসলিম এবং তুরিনের ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ। তবে নিজের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মা ও ভাইকে ওই বাড়ি থেকে ২০১৭ সালে বের করে দেন তুরিন আফরোজ। পরে ওই বাড়ির ভোগদখল ও মালিকানা দাবি করে শাহনেওয়াজ ও তুরিন ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে পৃথক দুটি দেওয়ানি মামলা করেন।

২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর উভয় পক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বাড়িটি ভোগদখলের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা জারি করে ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। সম্প্রতি ওই মামলার রায় নিজেদের পক্ষে পেয়েছেন সামসুন নাহার তসলিম এবং শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্কতুরিন আফরোজের মা সামসুন নাহার তসলিম

বিচারিক আদালতে করা মামলার আবেদনে তুরিন আফরোজ দাবি করেছিলেন, তার মা সামসুন নাহার তসলিম ১৯৯১ সালে ক্রয়সূত্রে উত্তরার সম্পত্তির মালিক হন। পরের বছর ১৯৯২ সালে তিনি তার স্বামী তসলিম উদ্দিনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তসলিম উদ্দিন ওই সম্পত্তি মেয়ে তুরিন আফরোজকে হেবা (দানপত্র) করে দেন।

তবে সামসুন নাহার ও তার ছেলে শাহনেওয়াজ আদালতে লিখিত জবাব দিয়ে বলেছিলেন, তসলিম উদ্দিন কখনো তার মেয়ে তুরিন আফরোজকে উত্তরার সম্পত্তি দানপত্র করেননি। বরং সামসুন নাহার তার ছেলে শাহনেওয়াজকে উত্তরার সম্পত্তি ১৯৯৭ সালে হেবা (দানপত্র) করে দেন। পরে ওই জমি শাহনেওয়াজের নামে নামজারি করে ১৯৯৯ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। রাজউকের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা বাড়িতে তারা ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন।

২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। তবে দল তাতে সাড়া দেয়নি।

বিচারপতি মানিকের সঙ্গে যে তালিকা দেন তুরিন
ইসলামপন্থি রাজনীতিতে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ এনে ১১৬ জন ধর্মীয় বক্তার একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত গণকমিশন।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্কব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

২০২২ সালের ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এ তালিকা তুলে দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণকমিশনের চেয়ারম্যান ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে কারাবন্দি)। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনটির সদস্যসচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ধর্মব্যবসায়ী বা ওয়াজকারী সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়। যা সেসময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ওইদিন সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। একই দিন নীলফামারীর জলঢাকায় ব্যারিস্টার তুরিনের ব্যক্তিগত কার্যালয়েও ভাঙচুর করা হয়েছিল।

এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর গত বছরের ২০ আগস্ট তুরিন আফরোজসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে হেফাজতের সমাবেশে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়। ওই ১৯ জনের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারও রয়েছেন।

টিটি/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।