উর্দুভাষী নিয়ে পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য প্রত্যাহার চায় নাগরিক সমাজ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১৪ পিএম, ০৩ মে ২০২৫

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে অভিহিত করে পররাষ্ট্র সচিবের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে নাগরিক সমাজ। শনিবার (৩ মে) নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানা গেছে।

বিবৃতি বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও পরে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীরা ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্য থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় বসতি স্থাপন করেন। সে সময় তারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হিসেবে মর্যাদার সঙ্গেই বসবাস করতেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তাদের কয়েকটি প্রজন্ম এ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক কমিটি ফর রেড ক্রসের (আইসিআরসি) সহায়তায় এ জনগোষ্ঠীকে দেশের বিভিন্ন জেলার ১১৬টি ক্যাম্পে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়।

২০০১ সালের ৩৮৩১ নম্বর এবং ২০০৭ সালের ১০১২৯ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা করেন এবং এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।

ওই রায়সমূহের আলোকে দেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নাম যথাযথভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯-এর ৭ ধারা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ৫ ধারা অনুযায়ী, কেবলমাত্র বাংলাদেশি নাগরিকরাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং দেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন দ্ব্যর্থহীনভাবে মীমাংসিত।

গত ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ সভায় (এফওসি) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিকে বাংলাদেশে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’দের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য অনুরোধ জানান।

একই দিনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, তিনি বলেন- ‘যারা বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছিলেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ২৬,৯৪১ জন আটকে পড়া পাকিস্তানিকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের তথ্য অনুসারে ১৪টি জেলার ৭৯টি ক্যাম্পে আরও প্রায় ৩২৪১৪৭ জন ব্যক্তি রয়েছেন।’

এই বিবৃতির মাধ্যমে দেশের সমগ্র উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত-এর মধ্যে সই করা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আলোকেও বাংলাদেশের বর্তমান উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে আটকে পড়া পাকিস্তানি বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী এবং তাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তান থেকে অভিবাসিত হননি; তারা দীর্ঘকাল এই ভূমির বাসিন্দা এবং জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। শুধুমাত্র মাতৃভাষার ভিত্তিতে তাদের আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে উল্লেখ করে দেওয়া বক্তব্য এক প্রকার ঘৃণামূলক ও মানহানিকর এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক আইনত নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে উল্লেখ করা কেবল ভুল নয় বরং ন্যায়বিচারের নীতিরও লঙ্ঘন। অধিকন্তু তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিশ্রুত মৌলিক অধিকার, বিশেষত অনুচ্ছেদ ২৭-এর অধীন আইনের দৃষ্টিতে সমতা; অনুচ্ছেদ ২৮-এর অধীন ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য না করা এবং অনুচ্ছেদ ৩১-এর অধীন আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারের লঙ্ঘন।

১৭ এপ্রিল ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ এপ্রিল উর্দুভাষী কমিউনিটির পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব বরাবর ব্যাখ্যা চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এখনও কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।

উক্ত বিষয়সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের দাবি হচ্ছে- পররাষ্ট্র সচিব তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতি থেকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের দাবি’ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ শব্দ বন্ধে অভিহিত করা বন্ধ করা হোক।

নাগরিক সমাজের পক্ষে যারা বিবৃতিতে সই করেছেন তারা হলেন
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট সারা হোসেন, লেখক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম, সাংবাদিক ড. সায়দিয়া গুলরুখ, মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেলিন, শিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল নোমান, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, লেখক অরূপ রাহী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন, সংগীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক বীথি ঘোষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজলী সেহরীন ইসলাম, বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শিফা নাজনীন, শিক্ষক ও সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান নাসিম, কবি শিমন রায়হান, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী নূহু আব্দুল্লাহ, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির একটিভিস্ট ও সদস্য মারজিয়া প্রভা, নৃবিজ্ঞান গবেষক সায়েমা খাতুন, লেখক ও অনুবাদক ওমর তারেক চৌধুরী, আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাবি শাখার আহবায়ক আরমানুল হক, গবেষক ও এ্যাক্টিভিস্ট রেংইয়ং ম্রো, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসরিন সিরাজ,শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ অলিউর সান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) শিক্ষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান, সাংবাদিক মো মুক্তাদির রশীদ, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন সাদাফ নূর।

এফএইচ/এমআইএইচএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।