আদানির সঙ্গে চুক্তিতে অনিয়ম: পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করবে দুদক
রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বেরিয়ে এসেছে ভারতের বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে পদে পদে অনিয়মের তথ্য। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে এক বছরে অন্তত ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে।
বিদ্যুৎ কেনার এ চুক্তির সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে শুল্ক ও কর অব্যাহতি। ২০২৪ সালে ২৭ নভেম্বর আদানির অনিয়ম নিয়ে ‘আদানির বিদ্যুতে মেগা শুল্ক ফাঁকি, পদে পদে অনিয়ম’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে জাগো নিউজ। চলতি বছরের এপ্রিলে আদানির চুক্তির অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর কথা জানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এবার বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানি গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের করা চুক্তির অনিয়ম অনুসন্ধান ও পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করতে নতুন তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে দুদক।
সংস্থাটির উপ-পরিচালক আল-আমিনকে দলনেতা করে এই দলে আরও রয়েছেন উপ-পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান। দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান পরিচালনা করবে এই নতুন কমিটি। তারা চুক্তির কাঠামো, আর্থিক ফিজিবিলিটি, সম্ভাব্য ক্ষতি ও অনিয়মসহ সব দিক থেকে বিস্তারিত পর্যালোচনা করবে। কমিটির তিন সদস্যই সরকারি প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী ও অভিজ্ঞ। তারা চুক্তিতে কোনো অনিয়ম বা স্বার্থসংঘাত হয়েছে কি না তা যাচাই করবে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে বিধি অনুযায়ী সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ দিন। যাচাই শেষে যদি চুক্তিটি অবৈধ বা অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়, তবে চুক্তি বাতিলের বিষয়ে সুপারিশও করতে পারবে কমিটি।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি।
আরও পড়ুন
চীনা অর্থায়ন-প্রযুক্তিতে বদলে গেছে দেশের উন্নয়নের চিত্র
আদানির বিদ্যুতে মেগা ‘শুল্ক ফাঁকি’, পদে পদে অনিয়ম
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করেছে।
ভারতের আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখবে বলে ৩ অক্টোবর জানায় এ কমিটি। এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন গড্ডা পাওয়ার প্লান্টও রয়েছে।
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, এতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না- এসব প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্ত শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দারা। প্রতিবেদনে কর ফাঁকির এই অর্থ পিডিবির কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দাদের এ কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি।
২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় এনবিআর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে পিডিবি। যদিও কর, শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার এখতিয়ার শুধুই রাজস্ব বোর্ডের।
চুক্তির আওতায়, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যার মূল্য ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার। এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলিয়ে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা। চুক্তিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এটিকে বলা হচ্ছে ‘ফাঁকি’।
এসএম/কেএসআর/এমএস