ঢাকার পুলিশের দাবি ‘ফয়সাল ভারতে’, মেঘালয় পুলিশ বলছে ‘না’
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন ও তার সহযোগী ভারতে পালিয়েছেন বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালকে ভারতে পালানোর বিষয়ে সহায়তার অভিযোগে দেশটিতে দুজন গ্রেফতার হওয়ারও তথ্য দেন তারা। ঘটনার ১৬ দিনের মাথায় এ তথ্য জানালো পুলিশ।
তবে ঢাকার পুলিশের দেওয়া তথ্য ‘অস্বীকার’ করেছে মেঘালয় পুলিশ। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীও (বিএসএফ) ডিএমপির দাবি দুটি প্রত্যাখ্যান করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে এখন বড় প্রশ্ন- তাহলে হাদির হত্যাকারীরা গেলো কোথায়? যদিও এর উত্তরের জন্য আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
রোববার দুপুরে হাদি হত্যা মামলার অগ্রগতি জানাতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, হাদি হত্যার প্রধান দুই সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম এবং আলমগীর শেখ ভারতে পালিয়ে গেছেন। মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে ইনফরমাল চ্যানেলে যোগাযোগ করে তারা জানতে পেরেছেন, মেঘালয় পুলিশ ফয়সাল করিমকে সহায়তাকারী পুত্তি ও সামি নামে দুজনকে গ্রেফতার করেছে।
তিনি পালিয়ে যাওয়ার একটি বর্ণনাও দেন। এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই হিন্দুস্তান টাইমসের অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিএসএফ ও মেঘালয় পুলিশের বরাত দিয়ে ডিএমপির দাবি অস্বীকার করা হয়।
হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাদি হত্যার প্রধান দুই সন্দেহভাজন হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ে পালিয়ে গেছেন এবং এখন সেই রাজ্যে অবস্থান করছেন— বাংলাদেশ পুলিশের এমন বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন মেঘালয় পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, গত ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ময়মনসিংহের সীমান্তঘেঁষা উপজেলা হালুয়াঘাটের একটি দুর্গম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালান ফয়সাল ও আলমগীর। তাদের সীমান্ত পারাপারে সহায়তায় জড়িত কয়েকজন মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। যদিও এ দাবির পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ এখনো দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভারত অস্বীকার করায় বিষয়টি নিয়ে আরও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ১২ ডিসেম্বর হাদির ওপর হামলার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মূল সন্দেহভাজন হিসেবে ফয়সাল ও আলমগীরকে শনাক্ত করে এবং প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের গতিবিধি অনুসরণ করতে থাকে। তবে সন্দেহভাজনরা তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো (মোবাইল ফোনসহ অন্য প্রযুক্তি সামগ্রী) সচল রাখলেও সেগুলো নিজেরা বহন করেননি। এসব ডিভাইস অন্য কোনোভাবে চালু রেখে বারবার সেগুলোর জায়গা পরিবর্তন করানো হচ্ছিল।
পুলিশ যখন তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর অবস্থান ধরে ধরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছিল, তখন তারা রাজধানী থেকে নিরাপদে বের হয়ে ময়মনসিংহ হয়ে হালুয়াঘাট পৌঁছায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে হাদিকে গুলি করার পরই তারা পল্টনের কালভার্ট রোড থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে নয়াপল্টন হয়ে শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট হয়ে আগারগাঁও এলাকা দিয়ে মিরপুরে পৌঁছায়।
আরও পড়ুন
হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মেঘালয়ে প্রবেশের দাবি নাকচ করলো বিএসএফ
হাদির হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়েছে, স্বীকার করলো পুলিশ
হাদির হত্যাকারীদের দুই সহযোগী ভারতে গ্রেফতার
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ময়মনসিংহ সীমান্তের স্থানীয় সূত্রের দাবি, ফয়সাল ও আলমগীর সেখান থেকে প্রাইভেটকারে করে আশুলিয়া হয়ে গাজীপুর দিয়ে সড়কপথে ময়মনসিংহ যান। প্রাইভেটকারটি হালুয়াঘাটের ধারাবাজারের একটি পেট্রোল পাম্পে গিয়ে থামে। সেখান থেকে তিনজন যুবক এসে তাদের দুজনকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে হালুয়াঘাটের ভুটিয়াপাড়ায় নিয়ে যায়। রাত আড়াইটা পর্যন্ত থেকে ভুটিয়াপাড়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড় জেলার একটি পৌরসভা এলাকায় পৌঁছান।
মেঘালয় পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযুক্তদের কাউকেই গারো পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং কোনো গ্রেফতারও করা হয়নি।
হাদি হত্যায় অভিযুক্ত ফয়সাল ও আলমগীরের সীমান্ত পার হওয়া বা এ ঘটনায় পুত্তি ও সামি নামে দুজনের ভূমিকার পক্ষে কোনো গোয়েন্দা তথ্য, সরেজমিন যাচাই বা অভিযানগত কোনো প্রমাণ নেই বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
মেঘালয় পুলিশের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়েছে, পুত্তি বা সামি নামে কাউকেই মেঘালয়ের কোথাও শনাক্ত করা যায়নি, খুঁজে পাওয়া বা গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকার ভেরিফিকেশন বা সমন্বয় ছাড়াই এই বিবরণ তৈরি করা হয়েছে।
মেঘালয় পুলিশের এই দাবির পক্ষে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও সমর্থন জানিয়েছে বলে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিএসএফের মেঘালয় ফ্রন্টিয়ারের মহাপরিদর্শক ওপি উপাধ্যায় বাংলাদেশ পুলিশের দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেন, হালুয়াঘাট সেক্টর দিয়ে এই ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হয়ে মেঘালয়ে প্রবেশের প্রকার প্রমাণই নেই। বিএসএফের পক্ষ থেকে এমন কোনো ঘটনা শনাক্ত বা রিপোর্ট করা হয়নি। দাবিগুলো ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।
বিএসএফ ও মেঘালয় পুলিশের এমন অবস্থানের বিষয়ে জানতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এসএন নজরুল ইসলাম ও ডিএমপির ডিবিপ্রধান শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য বিশ্লেষণ ও পুলিশের তদন্ত ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য জানা যায়। এ বিষয়ে দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে।’
‘এখনই সবকিছু প্রকাশ করা যাচ্ছে না’
রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তের স্বার্থে এবং প্রকৃত অপরাধী ও মদতকারীদের শনাক্তকরণের জন্য এখনই শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের সবকিছু প্রকাশ করা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও অন্য গোয়েন্দা সংখ্যা নিবিড় ও সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সবাইকে এ বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অতিদ্রুত এ হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য এবং যারা এর পেছনে জড়িত তাদের নাম, ঠিকানাসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা জনসম্মুখে উন্মোচন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
হাদি হত্যা মামলাটির তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় ডিএমপি। আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলে ডিএমপি জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এটাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই মনে হচ্ছে।
২৭ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর শাহবাগে ইনকিলাব মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচিতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, হাদি হত্যার পেছনে মূলে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা উন্মোচন করা হবে।
হাদি হত্যায় এ যাবত গ্রেফতার ১১
এ যাবত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতাররা হলেন- ঘটনার মূলহোতা ফয়সাল করিম মাসুদের বাবা হুমায়ুন কবির, মা হাসি বেগম, স্ত্রী শাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, মো. কবির, নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, সিবিয়ন দিও, সঞ্জয় চিসিম, মো. আমিনুল ইসলাম রাজু ও মো. আব্দুল হান্নান। গ্রেফতারদের মধ্যে ছয়জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে এবং চারজন সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
যেসব আলামত উদ্ধার
হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জব্দ উল্লেখযোগ্য আলামত হলো- হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি বিদেশি পিস্তল, ৫২ রাউন্ড গুলি, ম্যাগাজিন ও ছোরা, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও ভুয়া নম্বর প্লেট, ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গুলির খোসা, বুলেট, সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রায় ৫৩টি অ্যাকাউন্টের মোট ২১৮ কোটি টাকার স্বাক্ষরিত চেক।
টিটি/এএসএ/এমএস