ঈদের সন্ধ্যায় লোকারণ্য হাতিরঝিল

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ পিএম, ১৪ মে ২০২১

ঈদুল ফিতরের আগে অনেকটাই জনমানবশূন্য ছিল রাজধানীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হাতিরঝিল। তবে, ঈদের দিন শুক্রবার (১৪ মে) বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিরঝিলে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। অনেকে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের অনন্দ উপভোগ করতে এসেছেন হাতিরঝিলে।

হাতিরঝিল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেউ ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে, আবার কেউ ঝিলের ধারে গাছের ছায়ায় বসে শীতল বাতাসে উপভোগ করছেন ঈদের আনন্দ। গল্প, আড্ডা আর ঝিলের ধারে ঘুরে বেড়াতেও দেখা গেছে অনেককে।

হালকা আলো পড়ে ঝলমল করছিল ঝিলের পানি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এলেমেলো বাতাস। এই উদোম বাতাসে দোল খাচ্ছে ঝিলের পানি। এই দৃশ্য হাতিরঝিলকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে দর্শনার্থীদের কাছে। তবে ওয়াটার ট্যাক্সিতে শুধু বিনোদন নয়, নিজ নিজ গন্তব্যেও যাচ্ছেন রাজধানীর কর্মব্যস্ত মানুষ।

ঈদ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলো এবার দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়নি। করোনা মহামারির বিস্তার রোধে কর্তৃপক্ষ অনেক আগ থেকেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বাসায় ঈদের আনন্দ পালনের আহ্বান জানিয়েছে সরকার। তাই, রাজধানীর বেশিরভাগ নিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় মানুষের চাপ পড়েছে হাতিরঝিলে।

প্রতিবছর ঈদের দিন রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। কোথাও নামে মানুষের ঢল। কিন্তু গত বছর এবং চলতি বছর করোনা মহামারির কারণে সে চিত্র নেই রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে।

চিড়িয়াখানা, জাতীয় জাদুঘর এবং অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। রাজধানীবাসী মনে করছিলেন করোনার কারণে ঈদ উৎসবের আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়বে। কিন্তু রাজধানীর হাতিরঝিলে আসলে যেকোনো মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।

নগরীর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হাতিরঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিকেল ৪টার পর থেকেই স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকেন। তখনো পশ্চিম আকাশে রোদ পুরোপুরি পড়েনি। সূর্যের প্রখর তাপ লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু, বিনোদনপ্রেমী মানুষ ছুটে আসছেন হাতিরঝিলে। সন্ধ্যার পরও আসেন অনেক মানুষ। রাতেও আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকেন বিনোদনপ্রেমী নগরবাসী।

hateerjhil-2.jpg

হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানান গেছে, রাজধানীর অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র সেভাবে খোলা না থাকায় গরম ও মানুষের ভিড় ওপেক্ষা করে তারা এখানে এসেছেন একটু সস্থির জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর প্রতিটি বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ। শাহবাগের শিশুপার্ক সংস্কারের জন্য গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ জাতীয় জাদুঘর, মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা, শ্যামলীর ডিএনসিসি ওয়ান্ডার ল্যান্ড। এ ছাড়া ওসমানী উদ্যান, রমনাপার্ক, জোড়পুকুর মাঠ, বাসাবোর শহীদ আলাউদ্দিন পার্ক, পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত রসুলবাগ পার্কসহ সিটি করপোরেশনের অন্যান্য মাঠ ও পার্কগুলো বন্ধ রয়েছে।

করোনা মহামারির মধ্যে এসব বিনোদনকেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ঈদের দিন বিকেল থেকেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন হাতিরঝিলে। কেউবা বসে গল্প করেন, কেউ বা হাঁটাহাঁটি কেউ, আবার চিরচেনা সেলফি তুলতেই ব্যস্ত থাকেন।

হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা বনশ্রীর বাসিন্দা আবদুস সলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাতে সময় কম থাকায় স্ত্রী-সন্তানদের হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে আনন্দ উপভোগ সম্ভব হয়নি কখনো। তাই আজ ঈদেরদিন বিকেলে ঘুরতে বের হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এখানে আসার সময় হয় না। অনেকদিন ধরে ছেলে-মেয়েরা বায়না ধরেছে ওয়াটার ট্যাক্সিতে ঘুরবে। ঈদেরদিন বিকেলে বাসা থেকে বের হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওরা কোনোমতেই ছাড়ছে না বলে দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ওয়াটার ট্যাক্সির রামপুরা কাউন্টারে আসলাম। দেখি একটু আনন্দ পাওয়া যায় কিনা।’

পরিবার-পরিজন নিয়ে উত্তরা থেকে হাতিরঝিলে এসেছেন খলিলুর রহমান। খোলা বাতাসে বসে ঝিলের ধারে ঘাসের ওপর বসে উপভোগ করছিলেন দর্শনার্থীদের পদচারণা ও ঝিলের সৌন্দর্য। আলাপচারিতায় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘লকডাউনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া আর নিজের ব্যস্ততার জন্য গ্রামের বাড়ি যেতে পারিনি। তাই ঢাকাতেই ঈদ করতে হলো। এখন ব্যস্ততার কারণে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে তেমন সময়ও দিতে পারি না। তাই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এসেছি।’

বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন আফিয়া ও তানিশা। তারা দু’জনেই রাজধানীর একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘ঈদেরদিন কোথাও বের হতে চাচ্ছিলাম না, তবে হাতিরঝিল এসে ভালই লাগছে।’

এফডিসি থেকে পুুলিশ প্লাজা, গুলশান গুদারাঘাট, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করতে ৩০ মিনিট সময় লাগবে। প্রতিটি টিকিটের মূল্য আলাদা আলাদা।

hateerjhil-2.jpg

ওয়াটার ট্যাক্সির ম্যানেজার জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সবকটি ট্যাক্সি চলাচল করে। আজ ঈদেরদিন ব্যাপক মানুষের সমাগম হয়েছে। ঈদ মৌসুমে আগামী কয়েকদিন বিনোদনপ্রেমীদের জন্য ঝিল উৎসবমুখর থাকবে।’

বর্তমানে কতটি ওয়াটার ট্যাক্সি চলছে তা জানাতে না পারলেও তিনি বলেন, ‘এক একটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৪৫ জন। টার্মিনাল আছে ৫টি-এফডিসি, পুলিশ প্লাজা, গুলশান মেরুল-বাড্ডা এবং রামপুরা। এ ছাড়াও চক্রাকার বাস রয়েছে।’

হাতিরঝিলের আকর্ষণ

মিউজিকের সঙ্গে ওয়াটার শো। খোলা আকাশের নিচে মনোরম পরিবেশে হাতিরঝিলে আলোর সঙ্গে পানির ফোয়ারা। মিউজিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে এসব ফোয়ারা। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন। এর ফোয়ারার পানি ১০ মিটার থেকে ৭০ মিটার পর্যন্ত ওপরে উঠে। মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন এবং অ্যাম্পিথিয়েটারের বাড়তি বিনোদন উপভোগ করার সুযোগ মিলেছে ঈদ উৎসবে। ফোয়ারা চালু থাকে ১৫ মিনিটের মতো। এটি উপভোগ করতে চাইলে সময়মতো আসতে হবে। কারণ এসব ফোয়ারা নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া হয়।

হাতিরঝিলের আশপাশের গুলশান, পুলিশ প্লাজা, মেরুল বাড্ডা, মধুবাগ ও মহানগর প্রজেক্ট এলাকা থেকে ১ হাজার ৯৮০ বর্গমিটারের এই রঙিন ফোয়ারা। হাতিরঝিলের গুলশান আড়ং ও পুলিশ প্লাজার মাঝামাঝি অংশে গোলাকার উন্মুক্ত মঞ্চ অ্যাম্পিথিয়েটার থেকেও তা উপভোগ করা যায়।

বসার জায়গা নিয়ে চিন্তা নেই, কেন না পুরো হাতিরঝিলজুড়েই বসার বেঞ্চ, টুল, সিড়ি ইত্যাদি রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য সর্বদা পুলিশ কাজ করছে বিভিন্ন পয়েন্টে।

ঝিলের নামকরণ

জায়গার নাম হাতিরঝিল সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। ভাওয়ালের রাজাদের পোষা হাতি রাখা হতো পিলখানায়। সেই সময় গোসল করার জন্য এসব হাতি ঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো অ্যালিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল এলাকা থেকে। আর হাতি গোসল করানোর কারণে ঝিলের নাম হয় হাতিরঝিল।

২০১৩ সালে ২ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এটি ঢাকার একটি অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং শ্রীবৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হাতিরঝিলকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয় এই বিনোদনকেন্দ্র।

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করা হয়েছে। উচ্চ সংক্রমণ আছে এমন এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য গত ২ এপ্রিল থেকে চিড়িয়াখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

এফএইচ/ইএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।