৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে কীভাবে টিকার আওতায় আনা হবে জানতে চায় টিআইবি
দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে কীভাবে, কত সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জানতে চেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া সম্ভাব্য সব উৎস থেকে টিকা প্রাপ্তির জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখারও সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের সুযোগ দেয়ারও সুপারিশ করা হয়।
মঙ্গলবার (৮ জুন) ‘করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ শীর্ষক’এক গবেষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব সুপারিশ করা হয়। অনলাইনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে অপরিকল্পিত ‘লকডাউন’ আরোপ করা হয়েছে। টিকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বা ১৩.৮ কোটি, যার জন্য প্রায় ২৮ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পিত উদ্যোগের ঘাটতির কারণে করোনার সংক্রমণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এন্ট্রি পয়েন্টগুলোতে (বিমান ও স্থলবন্দর) সংক্রমিত ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ এবং কোয়ারেন্টাইন করার উদ্যোগের ঘাটতির কারণে নেগেটিভ সনদ ছাড়া যাত্রী পরিবহন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে সিট সঙ্কট, স্বল্প সময় কোয়ারেন্টাইনে থাকা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় কোভিড-১৯ এর নতুন ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে সমন্বিত ‘আচরণ পরিবর্তনের’ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনার কঠোর বাস্তবায়নেও ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এছাড়া পৌরসভা নির্বাচন, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন, এবং পর্যটন কেন্দ্র খোলা রাখা হয়। উচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রচার ছিল উল্লেখযোগ্য।
র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট টেস্টের সম্প্রসারণ হলেও আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার এখনো ৩০টি জেলার মধ্যে সীমিত, এবং অধিকাংশ পরীক্ষাগার বেসরকারি। বাংলাদেশের বিদ্যমান আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় কিছু নতুন স্ট্রেইন শনাক্তে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। অনেক কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ করার ফলে আইসিইউসহ চিকিৎসা সঙ্কট ছিল।
বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড মোকাবিলায় বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত ছিল বলে লক্ষ করা গেছে। যেমন পাঁচটি হাসপাতালে ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ ও কোয়ারেন্টাইন বাবদ ৬২.৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি; ক্রয় বিধি লঙ্ঘন করে এক লাখ কিট ক্রয়; দর প্রস্তাব মূল্যায়ন, আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি, কার্য সম্পাদন চুক্তি, কার্যাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘন ও অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ প্রদানের ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। করোনাকালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। টিকার আনুষঙ্গিক উপকরণ ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ প্রদান করা হয়েছে বলে জানা যায়। কোনো হাসপাতালে শয্যা খালি নেই আবার কোনো হাসপাতালে রোগী নেই এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। উপযোগিতা যাচাই না করে হাসপাতাল নির্মাণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার না করে হঠাৎ বন্ধ করে দেয়ায় ৩১ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে।
এতে বলা হয় বাংলাদেশে টিকা প্রদানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ৩.৯৫ কোটি। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছে ৭১.৫ লাখ, প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছে ৫৮.২ লাখ, এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছে ৩২.১ লাখ।
যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২.১৯ ডলার), ভারত (২.৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) এবং নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। খরচ বাদে তৃতীয় পক্ষের প্রতি ডোজ টিকায় প্রায় ৭৭ টাকা করে মুনাফা হিসেবে প্রথম ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহে ৩৮.৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এভাবে তিন কোটি ডোজে তাদের মোট লাভ হবে ২৩১ কোটি টাকা। সরকার সরাসরি সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচতো তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন নেপালে সরাসরি এবং শ্রীলংকায় সরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল করপোরেশনের মাধ্যমে সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা ক্রয় করা হচ্ছে। তবে চীনের সঙ্গে সরকার সরাসরি ক্রয়-চুক্তি করেছে, এই চুক্তি অনুযায়ী চীনের টিকা বাংলাদেশ ১০ ডলার দিয়ে কিনছে যা বিশ্ব বাজারদরের (১০-১৯ ডলার) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এসব উত্তরণে আরও কিছু সুপারিশ করেছে টিআইবি। সেগুলো হলো:
সরকারি ক্রয় বিধি অনুসরণ করে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি আমদানির অনুমতি প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ব্যতীত টিকা ক্রয় চুক্তি সম্পর্কিত সব তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। পেশা, জনগোষ্ঠী ও এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের ঝুঁকি, আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সমভাবে বিবেচনা করে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে যারা বাদ পড়ে যাচ্ছে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত ও প্রত্যন্ত এলাকা বিবেচনা করে টিকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও টিকাদান কার্যক্রম সংস্কার করতে হবে; ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নিবন্ধন ও তৃণমূল পর্যায়ে টিকা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
সব কারিগরি ত্রুটি দূর করাসহ সবার জন্য বিভিন্ন উপায়ে নিবন্ধন প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিতে হবে (যেমন এসএমএসের মাধ্যমে, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে); সবার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন কার্ড প্রিন্ট করার নিয়ম বাতিল করতে হবে। এলাকাভিত্তিক চাহিদা যাচাই করে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। টিকা প্রদান কার্যক্রমে টিকা কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। টিকা কেন্দ্রে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; অভিযোগের ভিত্তিতে বিদ্যমান সমস্যা দূর করতে হবে ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কিত সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-
কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পসমূহ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এর অগ্রগতির চিত্র প্রকাশ করতে হবে।
স্টোরে ফেলে রাখা আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি অতি দ্রুততার সঙ্গে ব্যবহারযোগ্য করতে হবে এবং সংক্রমণ হার বিবেচনা করে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতে হবে। সব জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউসহ কোভিড-১৯ চিকিৎসার খরচ সর্বসাধারণের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চিকিৎসা ফি’র সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
এইচএস/এমআরআর/এমকেএইচ