পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৪ বছর: চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনো মামলার

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
পিলখানায় নিহত কর্মকর্তাদের মরদেহ বহনকালে কান্নায় ভেঙে পড়েন সহকর্মীরা

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সকাল ৯টায় রাজধানীর পিলখানায় দরবার হলে শুরু হয় বার্ষিক দরবার। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ দুই হাজার ৫৬০ জন সদস্যে তখন পরিপূর্ণ দরবার হল। দরবার মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

দরবারে বিডিআর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে সিপাহি মইন ও সিপাহি কাজল অতর্কিত মঞ্চে প্রবেশ করেন। মইন ছিলেন সশস্ত্র। কাজল পেছনে থাকেন আর মইন মঞ্চে উঠে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করেন।

মহাপরিচালক শাকিল আহমেদ সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। তখনই সিপাহিদের মধ্য থেকে ‘জাগো’ স্লোগান আসে। এরপরই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে পুরো পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

আরও পড়ুন: পিলখানা ট্র্যাজেডি, শতবর্ষী জুলেখা বেগমের স্বপ্ন কি পূরণ হবে?

সেদিন কিছু বিপথগামী সদস্য দাবি আদায়ের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায়। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের পাশাপাশি তৎকালীন মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিপথগামী বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরাও। তারা নারী ও শিশুসহ ১৭ জন বেসামরিক নাগরিককেও নির্মমভাবে হত্যা করে।

বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নিম্ন আদালত থেকে হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে।

jagonews24

একই সারিতে পাশাপাশি দাফন করা হয় পিলখানায় নিহত কর্মকর্তাদের মরদেহ

২০২০ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে খালাস চেয়ে ২০৩ আসামি আপিল করেন। আর ৮৩ জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে করা হয় ‘লিভ টু আপিল’।

আরও পড়ুন: দরবার হলে সেদিন যা ঘটেছিল

এ অবস্থায় এখন আপিল শুনানির উদ্যোগ নিলে বিচারের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদনের সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

কী ঘটেছিল সেদিন
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকেন তারা।

বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।

মামলার রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন
বিজিবি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, ২০০৯ সালের বর্বরোচিত এই ঘটনার পর দুটো ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে বিস্ফোরক মামলাটির শুনানি এখনও নিম্ন আদালতে চলছে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে ৮৫০ আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ২৭৮ জনকে খালাস দেন আদালত। রায় ঘোষণার আগেই মারা যান চার আসামি।

আরও পড়ুন: স্বজন হারানোর বেদনা আজও কাঁদায়

নিম্ন আদালতের রায়ের বিপরীতে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ৫৫২ জনকে বিচারের আওতায় এনে বাকি ২৮৩ জনকে খালাস দেন আদালত।

উচ্চ আদালতে শুনানি চলাকালে আরও ১১ জনের মৃত্যু হওয়ায় মোট ৮৩৫ জনের বিরুদ্ধে শুনানি হয় আলোচিত এ মামলায়।

jagonews24

অস্ত্র হাতে বিডিআর সদস্যরা

নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। আট জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এরপর আসামিদের অনেকেই আপিল বিভাগে আপিল করেন, যার শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আর বিস্ফোরক মামলাটির বিচার এখনও চলছে নিম্ন আদালতেই।

অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন বলেন, আলোচিত এ মামলার শুনানি হতে পারে চলতি বছরেই। আপিলের সারসংক্ষেপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে। সেটি চার সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে হতে পারে, এর বেশি কোনোভাবেই হবে না।

আরও পড়ুন: পিলখানা হত্যায় ৭১ আপিল, বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যই শেষ হয়নি

এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেছেন, আমরা সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, পিলখানার ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার যেন হয়, বিচারকেরা তাই করেছেন। যে মামলার বিষয়টি চলমান সেটি খুব শিগগির শেষ হবে। বিচার শেষ হওয়ার পর আপিল করার একটি সুযোগ থাকে, সেটাও হয়েছে। আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়া শেষ হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। এ রায় যথার্থভাবে কার্যকর করা হবে।

বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০’ পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাহিনীর সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবির নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন এবং মনোগ্রাম উন্মোচন করেন। এর মধ্যদিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা।

পিলখানায় শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠানসূচি
পিলখানা ট্র্যাজেডির দিনটিতে নিহতদের স্মরণে কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি। এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজে জানান, পিলখানায় ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদদের স্মরণে শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হবে।

শনিবার সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া বিজিবির সব সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ দরবার।

টিটি/কেএসআর/এমএস

বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নিম্ন আদালত থেকে হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে।

আলোচিত এ মামলার শুনানি হতে পারে চলতি বছরেই। আপিলের সারসংক্ষেপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে। সেটি চার সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে হতে পারে, এর বেশি কোনোভাবেই হবে না।

পিলখানার ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার যেন হয়, বিচারকেরা তাই করেছেন। যে মামলার বিষয়টি চলমান সেটি খুব শিগগির শেষ হবে। বিচার শেষ হওয়ার পর আপিল করার একটি সুযোগ থাকে, সেটাও হয়েছে। আমরা মনে করি, এই প্রক্রিয়া শেষ হলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।