বাংলাবান্ধায় নতুন দিগন্তের সূচনা
আকাশ ছোঁয়া হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ের নৈসর্গ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের শহর তেঁতুলিয়া। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকায় শহরটি পরিণত হয়েছিল অভাবী মানুষের জনপদে। সেই তেঁতুলিয়াতেই এখন নতুন দিগন্ত হাতছানি দিচ্ছে। শুরু হয়েছে দিন বদলের প্রতিযোগিতা। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দীর্ঘ প্রত্যাশিত ইমিগ্রেশন কার্যক্রম। কাঙ্ক্ষিত এই সুবিধাটির জন্য এতোদিন উভয় দেশের মানুষ বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে। বহু প্রতীক্ষিত ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার কারণে সর্বস্তরের মানুষ আজ আনন্দিত।
অভাব পীড়িত এই জনপদের মানুষের মূল পেশাই ছিলো শ্রম বিক্রি। নদী থেকে পাথর তোলা কিংবা চা বাগানে শ্রম দিয়ে জীবন চলতো তাদের। কিন্তুু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের আশেপাশের মানুষ এখন অভাবকে না বলছে। তারা স্বপ্ন দেখছে এক নতুন বাংলাদেশের।
কথা হয় তেঁতুলিয়া বাজার এলাকায় দিনমজুর আব্দুল হামিদের সাথে। তিনি বললেন, “ হামাএলা খুব উন্নতি হোবো। হামাক আর পাথর উঠাবা লাগিবা নাহায়।"
পাশেই রুটি বিক্রেতা আজমল মুন্সি বলেন, "এইডা হামাকের অনিক দিনের দাবি আছিল। এলা পূরণ হইছে। এলা হামরা খুশি। প্রধানমন্ত্রীক হামরা ধন্যবাদ জানাচ্চি।"
ব্যবসায়ীদের মতে ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শুরু হবার কারণে এখন বদলে যাবে পঞ্চগড় জেলার চিত্র। পরিণত হবে শিল্প নগরীতে। নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটবে বহুগুন।
একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আশরাফুল আলম পাটোয়ারি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাংলাদেশের ৩২ সদস্যের একটি টিম ওপার ঘুরে এসেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকে নিয়ে এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে শিগগিরই শিলিগুড়ি যাওয়া হবে। সেখানে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের প্রতিনিধিরাও আসবেন।
তিনি আরও বলেন, এ চার দেশের (সংক্ষেপে বিবিএনআই) একটি যৌথ চুক্তি হয়েছে। সেখানে আলাপ হবে কীভাবে এই এলাকাকে আরও শিল্পবান্ধব করা যায়। কারণ বিবিএনআই’র গেটওয়ে হবে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়, শিলিগুড়ি, বিরাটনগর ও ফুটসিলিং এই এলাকাকে নিয়ে বিবিএনআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ঘোষণা করবে। বিবিএনআই’র ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের হেডকোয়ার্টার পঞ্চগড়ে হওয়াসহ এ জেলা আগামীতে শিল্পনগরীতে পরিণত হবে।
পঞ্চগড়ের ভোজনপুর বাজার এলাকার পাথর ব্যবসায়ী আমিন, ফকরুল ও মনিরুল জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। সকালে রওনা হলে রাতের মধ্যেই ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে পৌঁছানো যায়। তারপরেও ইমেগ্রেশন না থাকার কারণে পিছিয়ে ছিলো সবকিছু। এখন আমরা ভালো কিছু আশা করছি। সে কারণে এলাকার জায়গা জমির দামও হঠাৎ বেড়েছে।
কাজি-টি স্টেট এর কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, এই এলাকায় সমতল জমিতে চা চাষ হয়। আবহাওয়া জনিত কারণে এখানে চা ব্যবসা লাভজনক। এ কারণে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে দেখা যায় চা গাছ। এখন এই ব্যবসাটিও শিল্পে রুপান্তরিত হবে। সরেজমিন বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, উভয় দেশের সরকার ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ইমিগ্রেশন চালুর জন্য বাংলাবান্ধা ও এর বিপরীতে ভারতীয় সীমান্তের ফুলবাড়ীতে আধুনিক ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই প্রতিটি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষের দিকে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যতগুলো স্থলবন্দর চালু রয়েছে তার মধ্যে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বন্যামুক্ত ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে একটি ভিন্ন মাত্রিক অবস্থানে রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব ভালো।
এই বন্দরের বিপরীতে ফুলবাড়ী থেকে মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে নিউ জলপাইগুড়ি সংক্ষেপে এনজিপি রেলস্টেশন অবস্থিত। এই রেলস্টেশন থেকে ভারতের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে। এছাড়া, ভারতের শৈল্য শহর দার্জিলিং ৮৫ কিলোমিটার, নেপাল সীমান্ত ৫৪ কিলোমিটার, ভুটান সীমান্ত ১৩০ কিলোমিটার ও চীন সীমান্ত ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাংলাবান্ধার পার্শ্ববর্তী ভারতের শিলিগুড়ির মতো সমৃদ্ধ এতো বড় শহর অন্যান্য স্থলবন্দরের কাছে নেই। বাংলাবান্ধা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিলিগুড়ি শহর থেকে রেল, আকাশ, সড়ক পথে ভারতের যেকোনো প্রান্তে অনায়াসে যাতায়াত সম্ভব। ব্যবসায়িক, পর্যটনসহ সকল সুযোগ-সুবিধা শিলিগুড়ি শহরে বিদ্যমান রয়েছে। ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে যাওয়ার একমাত্র করিডোর হচ্ছে শিলিগুড়ি।
অন্যদিকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে উপজেলা শহর তেঁতুলিয়ার দূরত্ব ১৮কি:মি:, পঞ্চগড় জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র ৫৪ কি:মি:, রাজধানী ঢাকার দূরত্ব ৬০০কি:মি:। তেঁতুলিয়া পঞ্চগড় থেকে বাংলাদেশের সকল বিভাগীয় শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা চমৎকার।
ইমিগ্রেশন কার্যক্রম হওয়ায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার পাওয়াসহ পঞ্চগড় জেলার উন্নয়নের পাশাপাশি বদলে যাবে চিত্র। বাংলাবান্ধার বিপরীতে ভারতের শিলিগুড়িতে ফুলবাড়ী স্থলবন্দরের অবস্থান। এ শিলিগুড়ি ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টারস খ্যাত আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, লাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল ও মেঘালয় রাজ্যের একমাত্র প্রবেশপথ। একই সঙ্গে ফুলবাড়ী দিয়ে নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গেও সহজ সংযোগ রয়েছে। এখানে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা হওয়ায় বুড়িমারী-চেংড়াবান্ধা বা হিলি হাকিমপুরের চেয়ে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার কম হওয়ায় ব্যবসায়িরা বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী স্থলবন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করবে। আর ইমিগ্রেশন চালুর পাশাপাশি স্থলবন্দরটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হলে বছরে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
বন্দরের শুল্ক বিভাগের রাজস্ব কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হলে এটি দেশের অন্যতম বন্দরে পরিণত হবে। ইতোমধ্যেই উভয় দেশের সীমান্ত এলাকায় অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরী করা হয়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে পারিপার্শিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে।
তেঁতুলিয়া বাজার সমিতির নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলে রংপুর বিভাগের লাখ লাখ মানুষসহ বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ভারতগামী রোগী, পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা উপোকৃত হবেন। অপরদিকে দার্জিলিং, গ্যাংটক, ডুয়ার্স ভ্রমণকারী পর্যটকরা অনায়াসে বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবনসহ দেশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এতে দেশের পর্যটন শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২২শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি করার জন্য বাংলাবান্ধা ও ফুলবাড়ী দিয়ে পণ্যবোঝাই ট্রাক চলাচলের উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে বাংলাবান্ধার বিপরীতে ভারতের ফুলবাড়ীতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ইমিগ্রেশনসহ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ৫ বছর পর সেটি বাস্তাবায়ন করা হলো।
লিমন বাসার/এফএ/এমএস