দগ্ধ সুমাইয়ার আহাজারিতে হার মেনেছে মানবতা (অডিও)


প্রকাশিত: ০২:৩৩ এএম, ০২ মার্চ ২০১৬

কে বলেছে মানুষ মানবিক! উত্তরায় লিক থেকে বের হওয়া গ্যাসের আগুনে দগ্ধ গৃহিনী সুমাইয়ার কথায় মানুষের মধ্যে মানবতার লেশ টুকুও মেলে না। এখানে যেন হার মেনেছে মানবতা।   

আগুনে পুড়তে পুড়তে সাত তলা থেকে নিচে নেমে এসেছেন তিনি। স্বামীকে নিয়ে। উপরে বাচ্চারা পুড়ছে। নিজেরাও। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে নামতে প্রতি ফ্লোরে বাঁচার জন্য আহাজারি করেছেন। চিৎকার করে বলেছিলেন বাঁচান বাঁচান। কিন্তু এগিয়ে আসে নি কেউ। শুধু কি তাই? পুড়তে থাকা দু’জন মানুষকে দেখেও দরজা আটকে দিয়েছে অন্যরা। মানুষের মানবতা তাহলে থাকলো কোথায়।

নিজের দুই ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুয়ে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা খুলে বলেন সুমাইয়া। তার পাশে দাঁড়ানোর আহাজারিতে মানুষ কতোটা হৃদয়হীন হয় উঠেছে সেসব কথাই বলেন তিনি।  

তিনি বলেন, যে রুম বন্ধ ছিল ওই রুমে গ্যাস জমা হয়। আগুন লাগার সঙ্গে ঘরগুলা আটকে গেলো। এই। আমি আর শালিনের আব্বু নিচে নাইম্মা আসছি। পিচ্চিটা উপরে।

পাশ থেকে আত্মীয়ের প্রশ্ন, তোমরা নিজেরাই নামছো? হ্যাঁ দৌড়ে নামতেছি আর চিৎকার করতেছি। আগুন জ্বলতেছে। দাউ দাউ করে। ওই সময় তো ঘরে আগুন পুরা। তখন ওর আব্বুকে আমি বলি গেট খুলো। গেট খুলি নামি আর চিৎকার করতেছি। আমাদের আগুন লাগছে সাহায্য করেন। বাঁচান বাঁচান। তিন নম্বর ফ্লোর আর সামনের ফ্লোর। দরজা খুলছে। খুইলা আমাদের দেইখা দরজা আটকায় দিছে। স্পষ্ট মনে আছে। দরজা খুইলা দেহে আগুনওয়ালা মানুষ নামতেছে। দরজা আটকায় দেয় কতো অমানবিক। চিন্তা করো।

ওই তিন তলার লোক যদি একটু একটা তোশক আইনা জড়ায় ধরতো? ওনার না হয় একটা তোশকই যাইতো। আমার বাচ্চাগুলা তো বাঁচতো। যদিও হায়াত নাই। আল্লাহর হুকুম।

sumaiyaশালিনকে কি তোমরা নিয়া নামছো। না। পরে আমরা নিচে নাইমা। পুরা কাপড় তো পুইরা গেলো। পিছে ছিল ছালার চট। ওইটা টাইনা আমার গায়ে দিছি। কতো মানুষ। সবাই তাকায় রইছে। কেউ আগায় না। বলি  আমি মহিলা মানুষ। আমারে একটা চাদর দেন। কেউ দেয় না। বিল্ডিংয়ের মহিলারা কেউ দেয় না। কতো খারাপ মানুষ। আল্লাহ মাফ করুক সবাইরে। ঈমান দেইক।

শেষে চিল্লাই এসে দারোয়ানকে বলছি, আমার দু ছেলে উপরে আটকা পড়ছে। একটু তাড়াতাড়ি যান। ও পুড়ে গেছে। কিন্তু সুমাইয়ার আত্মীয়রা জানান, দারোয়ান যায় নাই। শালিন মারা যাওয়ার আগে এমনটায় জানিয়েছে। শালিনের কথা, আমি সাত তলা থেকে এক নামছি। আমারে কেউ ধরে নাই। আমারে কেউ সাহায্য করে নাই।  

সুমাইয়া বলেন, শালিন পুড়ছে বেশি। শালিনের গায়ে পায়ে থপথপে হয়ে গেছে। ও বলে আম্মু আমি তো বাঁচবো না। আমারে মাফ কইরা দিও আম্মু। আমি বলি, বাবা তুই বাঁচিস। আমি মইরা যাই। দেখ বাবা মানুষের এ রকম হয়। দুনিয়া কি খারাপ না। কেউ কারো সাহায্য করে না। এটা একটা কথা।

তার বক্তব্যে উঠে আসে গ্যাস ছিল ডাইনিংয়ে আর শালিনের রুমে। রান্না ঘরে ছিল না। একটা মানুষও সাহায্য করেনি। বাড়িওয়ালা বিল্ডিংয়েই ছিল না। বাড়িওয়ালা সামনেও আসেনি। দারোয়ানও সাহায্য করেনি। জানালা আছে। জানালা খোলা নেট ছিল। ডাইনিং রুম ছিল আটকানো। রান্না ঘর পোড়েনি। পিচও গলেনি।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের ভাড়া বাসার গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য গুরুতর দগ্ধ হন। ওই দিনই সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ১৫ বছরের সারলিন বিন নেওয়াজ ও তার ছোট ভাই ১৪ মাস বয়সী জায়ান বিন নেওয়াজ।

দুই সন্তানের পর পরদিন বিকেলে মারা যান বাবা শাহনেওয়াজ। প্রায় ১২ ঘণ্টা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের ফ্রিজে দুই ভাইয়ের মরদেহ রাখার পর স্বজনরা লাশ নিয়ে বরিশাল গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে।  

কেবল আশঙ্কামুক্ত এই দম্পতির মেজ ছেলে জারিফ বিন নেওয়াজ। মা সুমাইয়া খানম যদিও বেঁচে আছেন তবে তারও ৭৪ ভাগ পুড়ে যায়।



জেইউ/এএইচ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।