অর্ধেক আকাশের জন্য মাত্র একটা দিন?


প্রকাশিত: ০৬:০৯ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৬

অনামিকা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে সেরকম একটা স্বপ্নের সমাজ গড়ার কথা, যেখানে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ জুড়ে থাকবে নারীরা। শতফুল বিকশিত করার সেই স্বপ্ন এখনও যেন স্বপ্নই রয়ে গেছে। অর্ধেক আকাশের জন্য মাত্র একটা দিন ? সমাজের যারা অর্ধাংশ, যাদের বাদ দিয়ে সমাজ সৃষ্টিই হতো না তাদের জন্য কি কেবল একদিনই বরাদ্দ? আজ বাংলাদেশ, দেশের গণ্ডি ছেড়ে বিশ্বজুড়েই পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছরই ক্যালেন্ডার ধরে দিনটি আসে, চলেও যায়। দুনিয়াজুড়ে ফের বাৎসরিক একবার নারীর অধিকার-স্বাধীনতা নিয়ে, নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা আঙ্গিকে আলোচনা হয়। তারপর যেমন চলার, চলে তেমনই। দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন, সঙ্গে নির্যাতনের ধরনও পাল্টাচ্ছে। চোখ উপড়ে নেয়া, শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো বর্বরতা বাড়ছে। নারীর অধিকার বাস্তবায়ন, সম্মান রক্ষাসহ নারীর উন্নয়নে তৈরি আইন কার্যকরী করার ঘাটতিও আছে ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। আইন কার্যকরী করতে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা সীমাহীন। তাই দিন আসে, দিন যায়। নারীরা বাহির কিংবা ঘরের অন্দর মহলেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যৌন আক্রমণ থেকে বাঁচতে সব সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়।

পুরুষদের ভুলে গেলে চলবে না, নারী ছাড়া সমাজ অচল, নারী সমাজ ধরে রাখে। নারী দিবস উপলক্ষে নারীর অধিকার রক্ষায় সভা-সেমিনার আর নানা প্রতিশ্রুতির ঝড় উঠে। কিন্তু, এটাতো ঠিক যে, শত প্রতিশ্রুতির মধ্যে অধিকাংশ প্রতিশ্রুতিই ভাতাবাজি-ভাঁওতাবাজির। যে পুরুষ অধিকার নিয়ে কথা বলেন, অধিকার বাস্তবায়নে সামনের সারিতে থাকেন তাদের কাছে নারী নিরাপদ কী না? তাদের ঘরে নারী নিরাপদ কী না? এমন প্রশ্ন উঠে আসছে সমাজে নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া বর্বরতা দেখে। এ জন্য আন্দোলনকারীদের পিছিয়ে যাওয়াটা বোকার কাজ হবে, কারণ যাদের কথা আর কাজে মিল নেয় তাদের সংখ্যা খুব এটা বেশি নয়। নারীকে সম্মান-ভালোবাসা, অধিকার- স্বাধীনতা দিতে না পারার চেয়ে ব্যর্থতা একজন পুরুষের আর কী হতে পারে। ফিরে আসি নারী দিবসটি নিয়ে, প্রশ্ন উঠছে নারী দিবস পালনের মধ্যে আন্তরিকতা কতখানি? আর আনুষ্ঠানিকতাই বা কতটা? এক-আধটা নারী দিবস পালনে কি আদৌ কি কিছু বদলাবে?  

মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজে নারীদের ভূমিকা, অধিকার সর্ম্পকে যে দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন, নারী মুক্তি লড়াইয়ের পক্ষে তাই পথ চলার ধ্রুবতারা। শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার সেই মতাদর্শ। এক বিশেষ আন্দোলনের ইতিহাস বহন করে এই বিশেষ দিনটি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ঐ আদর্শে অবিচল আস্থা রেখেই আমরা নারী মুক্তির স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে ঘরে বাইরে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে এগোবার পথই খুঁজি। ১৮৬৮ সালে শ্রমিকশ্রেণির প্রথম আন্তর্জাতিক কার্ল মার্কস কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকারের কথা বলেন। ১৮৭১-এ সেই নিশানা ঠিক করেই দর্জি, নারী শ্রমিক, হোটেল, লন্ডি, সেলুন, আর্ট সর্বস্তরের নারী শ্রমিকরা মিলিত হয়েছিলেন তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ নিউইয়র্কে নারী দর্জি শ্রমিকরা মেয়েদের ভোটাধিকার ও সমান মজুরির দাবি আদায়ের জন্য ঐতিহাসিক আন্দোলন করেন। তার পরের বছর ১৯০৯ সালে কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ওই সময় অংশগ্রহণ করেন ১৭টি দেশের প্রতিনিধি।

আমি নারী শিশুর প্রতি নির্যাতন রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখতে হচ্ছে আন্দোলনে রুপকাঠি, ধরন। উচ্চবর্ণের লোক যাকে ন্যায্য বলে, নিম্নবর্ণের কাছে অন্যায়। আমাদের দেশে নারী উন্নয়নে যে কয়টি নীতি রয়েছে, সেই সব নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন কী হচ্ছে? আমরা লক্ষ্য করি বিচার কোথায়? পরিবারের সম্মান, পণ প্রথা, স্বাধীন মতবাদ, শিক্ষা সব কিছুর প্রশ্নেই সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা কি ন্যায়ের কথা বলে? অধিকার আদায়ের কথা বলে? নারীর প্রতি সহিংসতা যেখানে দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেখানে মামলাও সমানতালে  স্তুপ হচ্ছে। ফলে অপরাধী বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুনরায় অপরাধ করছে। উদ্বেগের বিষয় অপরাধীরা অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে, চামচ, টেস্টার কিংবা স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে নারীদের চোখ উপড়ানো হচ্ছে। নারীদের গায়ে কেরোসিন পেট্রল বা অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ ঢেলে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ৮৭ শতাংশ নারী স্বামী এবং ৭৮ শতাংশ নারী আপনজনদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণের হারের কথা উল্লেখ অনুক্তই থাক, কারণ এর হিসাব বোধ হয় আর রাখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত কি দিন, কি রাত্রি, পথঘাট কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব কিছুই কলুষিত হচ্ছে এই জঘন্য অপরাধের জন্য। আতঙ্কিত হয়ে উঠছে সমগ্র সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষজন, শঙ্কিত হচ্ছে নারীসমাজ, বালিকা এমনকি শিশুরাও। আমার এক আত্মীয়, যার বয়স ৭ কি ৮ বছর। আমায় প্রায় বলে, ধর্ষণ কী, শিশু ধর্ষণ কী ? উত্তরে ধর্ষণের অর্থ দর্শন বুঝাতে চেষ্টা করি...। কিবা করার থাকে তখন...!

কাঠের বাক্স বোঝাই কাদা মাটি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে জমা করো, ছাঁচে ফেলে নরম মাটিকে ইটের সঠিক আকৃতি দাও, ভাঁটি থেকে বের করো, সেই ইট জায়গা মতো পরপর সাজিয়ে রাখো, পরিবারের জন্য রান্না করো, বাচ্চাদের খাবার খাওয়াও, ঝুপড়ি পরিষ্কার রাখো- এখানেই শেষ না, আরো আছে। মজুরি দেওয়ার লাইনে স্বামীর সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াও যাতে হিসেবে গোলমাল না হয় অথবা ঠিকাদার হিসেব গুলিয়ে দিয়ে যাতে পয়সা মারতে না পারে। ইটভাটার মহিলা শ্রমিকদের এই হলো রোজনামচা। একজন পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে সমানতালে হাড়ভাঙা খাঁটুনির পর রান্না করা, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া, সন্তানের দেখভালের নিত্য কাজ। কিন্তু জীবনটা যদি এমনও হতো বোধহয় মন্দের ভালো ছিল। তা হয় না। তাদের উপরও চলে শোষণ আর নানা নির্যাতন। সোমবার ( ৭ মার্চ) মালিবাগ ফ্লাইওভার’র নিচে কাজ করছিলেন ১০/১২ জন মহিলা। তাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়। তাদের ভাষ্য, ‘ বাবারে অনেক কাজ করি, ফাঁকি দেই না। পান, সিগারেট খাই না, মোবাইলও নেই। পুরুষরা কাজের মধ্যে অনেক  ফাঁকি দেয়, চুরুট টানার কথা বলে সময় নষ্ট করে। মজুরির বেলায় আমরা কম পাই, হেরা ( পুরুষ শ্রমিক) বেশি পায়’। মহিলা রাজমিস্ত্রি -সহকারী মহিলা শ্রমিকদের সরর্দার হানিফ সাহেব। কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, জানালেন, এটাই নাকি নিয়ম, মহিলারা কম পাবে, পুরুষরা বেশি পাবে। তারপর কিছুটা ক্ষোভ উগরে বললেন ‘যান ভাই যান, যার যার কাজ করেন’। এসব মহিলা শ্রমিকদের জমি নেই, কাজ নেই, নিরুপায় জীবন তাই মালিক-ঠিকাদারদের মুনাফার ফাঁসেই তারা বন্দী।

অনেকে হয়তো বলবেন, আমাদের নারীদের মহাকাশ অভিযানের কথা, তিব্বত জয়ের কথা, বলবেন সরকারপ্রধান, স্পীকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী মহিলাদের কথা। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, যাবেনও। কিন্তু, তাদের নিরাপত্তা কোথায় ? নারীরা যদি অর্ধেক আকাশের মালিক হন, কি হবে সেই আকাশের রঙ? সেই অর্ধেক আকাশে কি থাকবে-সূর্যোদয় নাকি সূর্যাস্ত? ঝলমলে রোদ্দুর নাকি মেঘের কালো ছায়া। কি থাকবে সেই আকাশ ছেয়ে? নারীরা কি বজ্রের ঝলকানি পাবে নাকি সাতরঙা রামধনু খেলবে তাদের সেই আকাশ জুড়ে? কেন তারা খণ্ডিত আকাশের স্বপ্ন দেখবে? কেন তাদের মজ্জায় বিচ্ছিন্নতাবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া হবে? কেমন মানুষের অধিকার পাবেনা নারীরা। কেন মানুষের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত তাদের বেলায় হবে না। কেন নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে শুধু মাত্র তারাই রাজপথে দাঁড়াবে?

নারী নির্যাতন বন্ধে সোচ্চার হতে হবে সর্বপ্রথম পুরুষদেরই। কারণ,ওই বোনটি আপনার, আপনার মতো কোনো ভাইয়ের বোন। অধিকার আদায়, সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধে, রুখে দাঁড়ানো ছাড়া পথ নেই। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া- রুখে দিতে হবে সকল নির্যাতন। আদায় করতে হবে মানুষের অধিকার। প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, নারীদের সম্মান-সুরক্ষার এই দায়িত্ব কেবল নারীদের হতে পারে না। সমাজের সব অংশের মানুষকে সমবেত ভাবে মানবতার উপর এই আক্রমণকে রুখে দিতে হবে। সেই লড়াইয়ে জোর আনতে আজ (বিশ্ব নারী দিবস) শুধু নয়, সব সময়, সর্বদা নারীদের পাশে পুরুষ থাকবে। ভাই, আজ শপথ নিন নারীর প্রতি আক্রমণকে রুখে দেওয়ার....।  

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।