আজও কাটেনি সে রাতের নিস্তব্ধতা

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২৩

১৪ আগস্ট দিনগত রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতেও জেগে নেই কেউ। কবিতার মতো ঘুমিয়ে আছে পাড়া। এমনকি নিরাপত্তারক্ষীরাও চলে গেছেন নিজ শয়নকক্ষে। তাদের চোখেও চলে এসেছে ঘুম।

কিন্তু ততক্ষণে সজাগ ও সক্রিয় অন্য কেউ। ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক নিয়ে জড়ো করা হয়েছে নির্মাণাধীন কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে।

পরিকল্পনা ও কাজ ভাগ করে ভোর ৪টায় তারা সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ধানমণ্ডি অভিমুখে রওয়ানা হয়। মেজর ডালিম এক প্লাটুন সেনাসহ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার দিকে রওনা দেন। আর শেখ মণির বাসায় আক্রমণের জন্য দুই প্লাটুন সেনা নিয়ে যান রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খান। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্যাংক আর ৩০০ সৈনিক নিয়ে রওনা হন মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ।

তখনও ঘুমিয়ে আছে পাড়া। জেগে শুধু নরপিচাশ ঘাতকরা। ভোর সোয়া ৫টায় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসায় আক্রমণ হয়। সেটির খবর চলে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মোহিতুল ইসলামকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোনে করতে বলেন। কিন্তু ফোনও কাজ করছিল না। লাইনে গণভবন প্রান্তকে পেলেও কথা বলছে না। এসময় রাষ্ট্রপতি নিজেই এসে ফোন হাতে নেন। ততক্ষণে সেখানেও আক্রমণ। জানালা দিয়ে মুহুর্মুহু গুলি শুরু।

আরও পড়ুন: বিশ্বনেতাদের চোখে বঙ্গবন্ধু 

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। ১৫ আগস্ট সকাল হয়েছে ঠিক। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার আজও কাটেনি। বাঙালি জাতির উপর কালো মেঘের ছায়ার মতো চেপে বসে। সেদিন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা মুক্তির মহায়নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে। একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াত ও তার কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই আবদুল নঈম খান রিন্টুকে হত্যা করে।

এই হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালির উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ বা কার্যক্রম না থাকলেও বিশ্ব বিবেক নাড়া দিয়েছিল। পরদিন (১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট) দ্য টাইমস অব লন্ডন এর সংখ্যায় উল্লেখ করেছে, ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

আরও পড়ুন: ইতিহাসের কলঙ্কিত বেদনাবিধুর এক দিন 

এই হত্যকাণ্ড নিয়ে পশ্চিম জার্মানীর নোবেল জয়ী নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে। এরা বিশ্বাসঘাতক।

আত্মঘাতী আর বিশ্বাসঘাতক যাই হোক, জাতি আজীবন বড়ে বেড়াবে এই কলঙ্কের দাগ। যদিও বঙ্গবন্ধু কন্যা ইতিহাসের মোড় পাল্টে দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করে জাতিকে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত করেছেন। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া পার করে রায় হয়েছে এবং আংশিক রায় কার্যকরও করেছেন। পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরে সরকারের প্রচেষ্টাও চলমান।

এসইউজে/এমএইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।