‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তৃতীয় ষড়যন্ত্র’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৪ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক। সাবেক মহাপরিচালক, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থায় মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। লিখছেন, গবেষণা করছেন নদী ও পরিবেশের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।

তিস্তা মহাপরিকল্পানা ও পরিস্থিতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: ফের ‘তিস্তা’ আলোচনা। চীনের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সরকারকে স্বাগত জানাতে গিয়ে তিস্তা নদীর মহাপরিকল্পনার কথা জানান দিয়েছেন আবারও। ভারতের মিডিয়া এ নিয়ে প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে। আসলে তিস্তা নদীতে কী হতে যাচ্ছে? আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: তিস্তা মহাপরিকল্পনা কিছুদিন আগের আলোচনা। সম্ভবত, চীনের পক্ষ থেকে আবারও আলোচনা তোলা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তৃতীয় ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনা সরকারের গত মেয়াদেই এটি বেশ আলোচনায় ছিল। চীন ও ভারতের প্রসঙ্গও এখানে গুরুত্ব পায়। মূলত বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের যে কৌশল তারই অংশ এমন পরিকল্পনা।

জাগো নিউজ: এ পরিকল্পনা তো তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণের। বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন কেন?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: দেখুন একটি দেশ বা অঞ্চলকে নানাভাবে দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নদী ও পানি নিয়ন্ত্রণ করেও দখলে রাখা যায়। শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে যখন ক্ষমতায় এলেন, তখনই তিস্তা নিয়ে একটি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তখন পানি সম্পদমন্ত্রী ছিলেন রায় রমেশ চন্দ্র সেন। তিনি বলেছিলেন, তিস্তা নদী নিয়ে একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে এবং আমরা সেচ মৌসুমে তিন হাজার ৫শ কিউসেক পানি পেতে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন>> ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু, তিস্তার পানি দেব কোথা থেকে’

কিন্তু এর কিছুদিন পরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বললেন, ‘তিস্তায় তো জল নেই’। তিনি পানি ও ভূগোল বিশারদ কল্যাণ রুদ্রকে দায়িত্ব দিলেন তিস্তার পরিস্থিতি জানতে। কল্যাণ রুদ্র একটি প্রতিবেদন দাখিল করলেন। ওই প্রতিবেদনটি মমতা ব্যানার্জী তার ড্রয়ারে রেখে দেন। সেটি আর বের করেননি।

আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশ এখানে হয় অহংকারের পরিচয় দিচ্ছে, নয়তো উদাসীনতার। বাংলাদেশ সরকার, যৌথ নদী কমিশনের অনেক কিছুই করার আছে। মমতা ব্যানার্জীর দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশ দিল্লির দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ, দিল্লিই তাকিয়ে আছে মমতার দিকে।

জাগো নিউজ: প্রতিবেদন প্রকাশ্যে না আনার কী কারণ থাকতে পারে?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: কল্যাণ রুদ্র বহু আগে থেকেই নদী নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তার অনেক প্রতিবেদনও আছে তিস্তার ওপর। সেই গবেষণায় তিস্তার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। ওই গবেষণাপত্রের সব কিছুই আমার হাতে আছে।

আমি বিভিন্ন আলোচনায় বা লেখায় তার গবেষণাই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করি। তিনি গবেষণায় দেখিয়েছেন অ্যান্ডারসন সেতুর কাছে ৯০ কিউবিক পানি আছে। অর্থাৎ সিকিম থেকে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের যে জায়গায় প্রবেশ করেছে, সেখানকার কথা বলছি। এই পানির বড় একটি অংশ বাংলাদেশ পাওয়ার কথা। পানির একটি অংশ ভারত পাবে, একটি অংশ বাংলাদেশ পাবে। আর বাকি অংশ নদী পাবে। নদী তো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তার মানে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই তিন ভাগের দুই ভাগ পেয়ে যাবে।

কিন্তু কি পাচ্ছি? কল্যাণ রুদ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী চুক্তি হলে রমেশ সেনের কথামতো ৩৫০০ কিউসেক পানি এখন তিস্তায় আসতো। অথচ তিস্তা এখন মরুভূমি।

জাগো নিউজ: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তিস্তার পানি নিয়ে আসলে কী বলতে চান?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: মমতা ব্যানার্জী বলছেন, ‘তিস্তায় জল নেই। দেব কোথা থেকে?’ ভালো কথা। কিন্তু তারই নিয়োগ করা গবেষক বলছেন ‘তিস্তায় জল ছিল।’ তাহলে এখন সেই জল গেলো কোথায়?

আরও পড়ুন>> ‘তিস্তার পানি বণ্টনে সহযোগিতার ক্ষেত্র এখনো রয়েছে’

বাংলাদেশের উচিত ছিল মমতা ব্যানার্জীর কাছে জানতে চাওয়া, চলেন দেখে আসি সিকিম থেকে আসা জল যাচ্ছে কোথায়? এটি বড় একটি বিষয়।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ এ উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন? আপনার কাছে কী মনে হয়?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশ এখানে হয় অহংকারের পরিচয় দিচ্ছে, নয়তো উদাসীনতার। বাংলাদেশ সরকার, যৌথ নদী কমিশনের অনেক কিছুই করার আছে। মমতা ব্যানার্জীর দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশ দিল্লির দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ দিল্লিই তাকিয়ে আছে মমতার দিকে। আমরা ভারতের এই চক্রে পড়ে গেছি। মমতা ব্যানাজী গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট এখন আটকে রেখেছেন। পানি আর আসে না।

জাগো নিউজ: শুষ্ক মৌসুমে নিংড়ানো বা চুইয়ে চুইয়ে আসার মতো করেও কিছু পানি আসে। এটি কি গজলডোবা ব্যারাজ থেকেই?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: না। গজলডোবা ব্যারাজের দক্ষিণে দোমোহনী সেতু আছে। জলপাইগুড়ি থেকে সরাসরি আসামে যাওয়ার এই সেতু। এর উজানে ধরলা নদী। সেখান থেকে ৫শ কিউসেক পানি এসে তিস্তায় পড়ছে। গজলডোবা ব্যারাজ পুরোই বন্ধ। যেটুকু পানি আসছে তা ধরলা নদী থেকে। তিস্তার পানি পুরোই ভারত অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ: এটি ঘটছে আসলে কখন থেকে?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: ভারতের পরিকল্পনা তো আগের। কিন্তু মমতা ব্যানার্জী যখন বললেন যে, তিস্তায় জল নেই, তারপর থেকেই তিস্তায় আর সেচ মৌসুমে পানি দিচ্ছে না। আমি একটি দৈনিকে সব দেখিয়ে বিস্তারিত লিখলাম। কারণ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আপনি এখন সবই দেখতে পাবেন।

আরও পড়ুন>> তিস্তার পানি আসবেই : প্রধানমন্ত্রী

আমি ছবি দেখিয়ে সব বুঝিয়ে দিলাম মমতা ব্যানার্জী কীভাবে সব পানি নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাবান্ধার ওপারেই তো শিলিগুড়ি শহর। এই শহরের দক্ষিণ দিয়ে পানি সরিয়ে মহানন্দা নদীতে নিচ্ছে। মহানন্দা নদীতে একটি ব্যারাজ আছে। বাংলাবান্ধা থেকেই ওই ব্যারাজ দেখা যায়। মহানন্দা ব্যারেজের ওপর দিয়ে নকশালবাড়ির দিকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আপনি নিজেও বাংলাদেশ থেকে দেখতে পাবেন।

তিস্তার সরিয়ে নেওয়া পানি ডাহুক নদীতে নিয়ে ফেলে দিচ্ছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি দেখলেই আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। ডাহুক নদী তেঁতুলিয়া ভেদ করে ভারতে গেছে। সেখানে গিয়ে পড়েছে মহানন্দা নদীতে। মহানন্দা নানা পথ ঘুরেফিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসতো। কিন্তু গত ৫০ বছরে একটি কাণ্ড ঘটে গেছে যে, মহানন্দা মাঝখানে বাদ পড়ে গেছে।

জাগো নিউজ: এই পানি সরিয়ে নিয়ে কী করছে সেখানে?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: এই পানির সঠিক ব্যবহার করছে না তারা। আমাদের না খাইয়ে রেখে পানি টেনে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ সেই পানির ব্যবহার করছে না। কারণ তাদের এই পানি ব্যবহার করার মতো প্রকল্পই এখন নেই।

আমাদের তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীনে চাষযোগ্য জমি রয়েছে ৬ লাখ হেক্টর। আর ভারতের তিস্তা সেচ প্রকল্প হচ্ছে ৯ লাখ হেক্টর। পশ্চিমবাংলার সব উত্তরবঙ্গজুড়ে এ প্রকল্প। কিন্তু এই ৯ লাখ হেক্টরের মধ্যে মাত্র এক লাখ হেক্টর প্রকল্প তারা নির্মাণ করেছে। বাকি জায়গা এখনো তারা সেচের আওতায় আনেনি। কিছুদিন আগে কোচবিহারে সামান্য জায়গা প্রকল্পের আওতায় এনেছে।

তাহলে এই পানি যাচ্ছে কোথায়? তিস্তার সরিয়ে নেওয়া পানি ডাহুক নদীতে নিয়ে ফেলে দিচ্ছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি দেখলেই আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। ডাহুক নদী তেঁতুলিয়া ভেদ করে ভারতে গেছে। সেখানে গিয়ে পড়েছে মহানন্দা নদীতে। মহানন্দা নানাস পথ ঘুরেফিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসতো। কিন্তু গত ৫০ বছরে একটি কাণ্ড ঘটে গেছে যে, মহানন্দা মাঝখানে বাদ পড়ে গেছে। মহানন্দা নদীর যে ফ্লো তা ভারতের অংশে এখন।

মহানন্দার কাছে আরেকটি নদীর নাম হচ্ছে মেচী। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে দেখবেন মেচী একটি খাল আছে। এই মেচী নদী এসেছে নেপাল এবং পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ধরে। এটি মহানন্দায় এসে মিট করেছে। এরপর এই নদীটা ফুলহার নামে গঙ্গায় চলে গেছে। তিস্তার সরিয়ে নেওয়া পানি মহানন্দা হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জেও আর আসছে না। মহানন্দা-মেচী মিলিত হয়ে ফুলহার নাম করে গঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। এই পানি কিন্তু বিহার হয়ে যাচ্ছে। বিহারবাসী সন্তুষ্ট থাকলেন। মমতা তিস্তার পানি নিয়ে দিল্লির আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে কাজে লাগাচ্ছে।

আমি প্রমাণসহ সব দেখিয়ে দিয়ে বলছি। আমাকে কেউ এ নিয়ে প্রশ্নও করে না। যারা জানেন তারাও না। আর যারা জানেন না, তারাও না।

জাগো নিউজ: তিস্তার ভবিষ্যৎ কী?

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক: তিস্তার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মতোই। আপনাকে মূলে যেতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আপনাকে আলোচনা করতে হবে। দৈনিক ও বাৎসরিকভাবে সব কিছু্র পরিবর্তন হয়। তিস্তার পানি যতই নিয়ে নিক, কিন্তু প্রতি বর্ষাকালে আবারো তিস্তা স্বরূপে ফেরে।

তিস্তার সর্বোচ্চ প্রবাহ ৩ লাখ কিউসেক ধরা হয়। আর সর্বনিম্ন প্রবাহ ৫ থেকে ১০ হাজার কিউসেক। ৩ লাখ থেকে ১ লাখ সরিয়ে নিলে ধরা যাবে না। কিন্তু ৫ হাজার থেকে ৪ হাজার নিয়ে গেলে তো ধরা পড়ে যাবে।

এএসএস/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।