যে দেশে যত সমস্যা, সে দেশে তত উদ্যোক্তা দরকার
সমস্যা শব্দটা আমরা সাধারণত নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করি। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোই এসেছে কোনো না কোনো সমস্যাকে সমাধান করতে গিয়ে। আগুন, চাকা, কলম, মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেট—এসব কিছুই মানুষের জীবনের জটিলতা কমাতে তৈরি হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, সমস্যাই নতুন সুযোগের জন্ম দেয়। আর যারা এই সুযোগকে চিনে তা সমাধানের মাধ্যমে সমাজ ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাদের আমরা বলি উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ, কিন্তু সেই সম্ভাবনার পেছনে লুকিয়ে আছে শত শত সমস্যা—দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অশিক্ষা, দূষণ, যানজট, কৃষিতে আধুনিকতার অভাব, প্রযুক্তির অভাব, শহর-কেন্দ্রিক উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্যাগুলোকে যদি শুধুই অভিযোগের চোখে না দেখে কেউ যদি সমাধানের সুযোগ হিসেবে দেখে, তাহলে সে-ই হবে আসল উদ্যোক্তা। আজকের পৃথিবীতে উদ্ভাবনী শক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে—Airbnb ঘর ভাড়া সমস্যার সমাধান দিয়েছে, Uber ট্রান্সপোর্ট সমস্যার, Pathao বাংলাদেশে ট্র্যাফিক আর ডেলিভারির চ্যালেঞ্জ থেকে এসেছে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন কর্মক্ষম যুবক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি হয় সর্বোচ্চ ৮-১০ লাখের জন্য। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ১০-১২ লাখ যুবক ও যুবতী কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হন। এই বেকারত্বই দেশের অন্যতম বড় সমস্যা, কিন্তু এটিই আবার উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় সুযোগ। কারণ একজন উদ্যোক্তা নিজে শুধু জীবিকার ব্যবস্থা করেন না, বরং অন্য দশজনের জীবিকাও তৈরি করেন।
বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা রিচার্ড ব্র্যানসন বলেছিলেন, “Business opportunities are like buses, there’s always another one coming.” কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অধিকাংশ মানুষ ‘চাকরি’কেই একমাত্র জীবননির্ভর উপায় হিসেবে দেখে। অথচ ব্যবসা কিংবা উদ্যোক্তা হওয়া মানেই নিজের পথ নিজে তৈরি করা। বিশেষ করে একটি দেশে যখন সমস্যা বেশি, তখন সমাধানের ক্ষেত্রও বেশি, ফলে উদ্যোগের সম্ভাবনাও অনেক বড়।
বাংলাদেশে অনেক উদ্যোক্তা আছেন যাঁরা গ্রামের সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। যেমন দিনাজপুরের হুমায়ুন কবির, যিনি দেখলেন কৃষকেরা ফল তোলার পরে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, ফুড প্রসেসিং-এর অভাবে সব নষ্ট হচ্ছে। তিনি শুরু করেন একটি ছোট ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট। আজ তিনি স্থানীয় কৃষকদের থেকে ফল নিয়ে জুস, জ্যাম ও শুকনো ফল তৈরি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পাঠান। তার ব্যবসার মাধ্যমে এখন ২০০ জনেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই হলো সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানমুখী উদ্যোগের উদাহরণ।
উদ্যোক্তা মানে শুধু পণ্য তৈরি বা বিক্রি নয়, উদ্যোক্তা মানে একটি ‘সমাধান-প্রদানকারী’ মনোভাব। বাংলাদেশে যদি শহরের পরিবহন সমস্যা দেখা যায়, তাহলে নতুন পরিবহন অ্যাপ তৈরি হতে পারে। যদি গ্রামে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার সমস্যা থাকে, তাহলে হস্তশিল্প, পাটজাত পণ্য, বা সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীনেতৃত্ব তৈরি হতে পারে। উদ্যোক্তা মানেই সমাজের সমস্যা দেখে কিছু করা—সমাধান উদ্ভাবন করা, প্রযুক্তি প্রয়োগ করা, দক্ষতা বাড়ানো এবং একটি টেকসই মডেল গড়ে তোলা।
বাংলাদেশের বিজনেস কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ‘LightCastle Partners’-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ এসেছে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষাপ্রযুক্তি এবং ই-কমার্স খাতে। এর মানে হচ্ছে, যেখানে যে সমস্যা, সেখানেই তরুণরা নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে সামনে আসছে। এই সংখ্যা এখনও কম, তবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
জনৈক একজন সফল ব্যবসায়ী একবার বলেছিলেন, “The more problems a country has, the more entrepreneurs it needs to solve them. We must encourage our youth to become job creators, not job seekers.” এটা নিছক বক্তব্য নয়, বাস্তবতা। ৮ কোটির অধিক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের একাংশ শুধু চাকরির জন্য বসে থাকলে, অর্থনীতি কখনোই গতিশীল হবে না। কিন্তু তাদের একটা অংশ যদি নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে ছোট উদ্যোগে নামে—তবে দেশেই তৈরি হবে লাখ লাখ কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিনির্ভর নতুন সেবা, এবং টেকসই উন্নয়ন।
তবে উদ্যোক্তা তৈরি শুধু উৎসাহ দিয়ে সম্ভব নয়। সরকার, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, মূলধন সহায়তা, বাজার সংযোগ এবং নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, “দেশের উন্নয়নে শিল্প ও ব্যবসা খাতের তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশ গড়তে হলে সবাইকে সৃষ্টিশীল হতে হবে।” সেই সৃষ্টিশীলতা এখন উদ্যোক্তাদের হাতেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মাদ ইউনুস বাংলাদেশের তরুণদের চাকরির পরিবর্তে উদ্যোক্তা হবার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। এটি একটি যথাযথ পদক্ষেপ । তবে আমার মনে হয় তরুণদের আগে তৈরি হতে হবে। তৈরি না হয়ে উদ্যোক্তা হবার পথে হাঁটলে পা পিছলিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল হবে।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ফিনটেক, এগ্রিটেক, গিগ ইকোনমি—এই খাতগুলোতে এখনো বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু সমানভাবে সমস্যা ও ব্যবধানও রয়েছে। এই ব্যবধান পূরণ করতে পারে উদ্যোক্তারা। তারা শুধু পণ্যের উদ্ভাবন করেন না, সমাজে কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনী পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও তৈরি করেন।
সবশেষে বলা যায়, যে দেশে যত সমস্যা, সে দেশে তত বেশি উদ্যোক্তার দরকার। কারণ সমস্যাকে সমাধানে পরিণত করাই একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় কাজ। বাংলাদেশে উদ্যোক্তা মানে শুধু ব্যবসায়ী নয়, একজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকারী, একজন সমস্যার সমাধানদাতা, একজন নতুন দিগন্ত উন্মোচক। যত সমস্যা, তত বেশি সুযোগ—এই বিশ্বাসে চললে, বাংলাদেশ খুব দ্রুতই এক নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।
লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট ও আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না” বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
এইচআর/এমএস