জাতীয় নির্বাচন: দায় কিন্তু সবার

সিরাজুল ইসলাম
সিরাজুল ইসলাম সিরাজুল ইসলাম , সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
প্রকাশিত: ০৯:০৭ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সমানভাবে ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হলে সে ব্যর্থতার ফলাফল মূলত এই দেশ এবং দেশের জনগণকে ভোগ করতে হবে। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো যে খুব লাভবান হতে পারবে তা কিন্তু নয়। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সরকার রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তারা কোনোভাবেই এই ভূমিকা থেকে সরে যেতে পারে না। যারা এই ভূমিকা পালন করবে না অথবা এই ভূমিকা পালনে বাধা সৃষ্টি করবে তারা রাজনীতির মাঠে এবং আগামী দিনের রাজনীতিতে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। খুব সহজে সেই কলঙ্ক মুছে ফেলা যাবে না।

সরকারের ঘোষণা মতো আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে দেশে নির্বাচনের একটি আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। এই দেশের মানুষ বহু বছর ধরে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে না। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা এখন ভোট দেওয়ার জন্য ভীষণভাবে আশাবাদী। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তারা ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে।

এই দেশে একসময় নির্বাচনী আনন্দ হতো ঈদ উৎসবের মতো। বলা যায়- ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি। কারণ ঈদের আনন্দ একদিন বড়জোর দুদিন থাকে। কিন্তু অতীত দিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব ধরনের নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগে থেকে মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ, পোস্টারিং, ব্যানার এবং ফেস্টুন ব্যবহার- এ সবকিছুর মধ্যে পরমানন্দ ছিল। নির্বাচনের সেই মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশে সব ধর্মবর্ণ গোত্র ও পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করত। গৈ-গ্রামের রাস্তাঘাটে আনন্দ উচ্ছ্বাস আর খুশির বন্যা বয়ে যেত বহুদিন ধরে।

ধীরে ধীরে নির্বাচন কাছে আসতো আর সে খুশি টানটান উত্তেজনায় রূপ নিত। অবশেষে নির্বাচন হতো এবং নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকরা আনন্দ মিছিল বের করত। কখনো কখনো খাওয়া-দাওয়া ভোজবাজিও হতো বটে। কিন্তু এখন সেই নির্বাচনী আমেজ আর নেই। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনটা যেমন তামাশায় পরিণত করেছে, তেমনি নির্বাচনের হাসি আনন্দ উচ্ছ্বাস উড়ে গেছে।

‌’২৪ এর জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয়ের পর আবার সেই নির্বাচনী উৎসব ফিরিয়ে আনার সুযোগ এসেছে। মানুষ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে কয়েকটি ইসলামী দলের নানামুখী তৎপরতা সেই উৎসবমুখর নির্বাচনের সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এক্ষেত্রে হঠাৎ দেশের রাজনীতিতে শক্ত হয়ে জুড়ে বসা পিআর পদ্ধতিকে তাদের তৎপরতার একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এসব দল ঘোষণা করেছে- পিআর পদ্ধতি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। যদি ব্যাপারটি তাই হয় তাহলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে গুরুতর সংশয় রয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। দলটি এ পদ্ধতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- যেসব দল এখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছে, তারা যেমন বিরোধীদল নয়, তেমনি এই পিআর পদ্ধতির বিরোধিতাকারী বিএনপি সরকারি দল নয়। বরং এই মুহূর্তে সরকারে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুস এবং তার সহযোগী কিছু মানুষ। বলতে মোটেই দ্বিধা নেই- এই সরকার তুলনামূলক দুর্বল।

পিআর পদ্ধতির দাবি যদি মেনে নিতে হয় তাহলে সরকারকে মানতে হবে, বিএনপিকে নয়। অন্যদিকে, যেসব দল পিআর পদ্ধতির দাবি জানাচ্ছে তারা কিন্তু সরাসরি নির্বাচন বানচালের দায়ে দুষ্টু হবে। যেসব তরুণ-তরুণী বহুদিন আগে ভোটার হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেনি তারা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হবে। এতে পিআর পদ্ধতির দাবিদাররা রাজনৈতিকভাবে গণবিচ্ছিন্ন হতে পারে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে আরও পরে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করে তা করা যেতে পারে, এবারের নির্বাচনে নয়। সে সময় এখন নেই, এটা সেই সময় নয়।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে এজন্য সবার ভূমিকা রাখা দরকার। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক সহনশীলতা দেখাতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্রকে একেবারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন নির্বিঘ্নে যাতে অনুষ্ঠিত হতে পারে, ভোটারটা যেন নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভোট অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ অনুকূলে রাখতে হবে।

এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনী বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তারা এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি তারা নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার পাবে। সাধারণ জনগণের বিরাট অংশ প্রত্যাশা করে- সেনাবাহিনী নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করবে। গণমানুষের এই প্রত্যাশার প্রতি অবশ্যই সামরিক বাহিনীকে সম্মান দেখাতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিও নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়বে।

সামগ্রিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে যে ক্ষতি হবে তা আমাদের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। এই ক্ষতি হতে দেওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না। আবারো বলি, সুন্দর একটি নির্বাচনের ব্যাপারে দেশ-সমাজ, রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামরিক বাহিনী- সবার দায় রয়েছে। সে দায় সাধারণ মানুষ ও ভোটারদেরও রয়েছে। আমরা কেউ যেন এই দায়িত্ব পালন থেকে বিরত না থাকি। তাহলে দেশ হেরে যাবে, হেরে যাব আমরা। ড. ইউনূসের সরকার ব্যর্থ হবে। তাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা আমাদের নিয়ে খেলতে সুযোগ পাবে। আমরা যেন কারও হাতের পুতুল না হই, কারও খেলনায় পরিণত না হই।

লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।